Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দৃষ্টিহীন চোখ নিয়ে বিজয়ের কান্না

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:১২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তাসনিম আক্তার সুইটি ও আসমাউল হুসনা দুই বোন। মা-বাবার কোল আলো করে পৃথিবীতে এলেও আলো ছিল না তাদের চোখে। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে নিজেদের জীবনকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলছেন তারা। দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সাফল্যের সঙ্গে এইচএসসির গণ্ডি পার করে প্রমাণ করে দিয়েছেন তারাও ‘ফেলনা’ নন। তবুও বিজয়ীর চোখে ছিল জল, সেই জল-সেই কান্না আনন্দের, বিষাদের নয়।

চট্টগ্রামে এমন অদম্য ছয় পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে সারাবাংলা, যাদের সবাই সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বিশেষ সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে কথা হয় তাদের সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

নগরীর হামজারবাগে শাহজাহান হাউজিং সোসাইটি এলাকার বাসায় সুইটি ও হুসনার সঙ্গে কথা বলার সময় সঙ্গে ছিলেন তাদের মা ফরিদা বেগমও।

নগরীর হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে সুইটি ৪ দশমিক ৩৩ ও হুসনা ৩ দশমিক ৯২ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিল দুই বোনের। তবে অন্যন্য সাধারণ মানুষের মতো চোখের দৃষ্টি না থাকায় সাধারণ স্কুলে পড়ার সু্যোগ তাদের হয়নি। ভর্তি হন মুরাদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা পাওয়ার পর ভর্তি হন ঝাউতলার বঙ্গবন্ধু বিদ্যাপীঠে। সেখানে অষ্টম শ্রেণি শেষ করেন।

এর মধ্যে নিখোঁজ হন তাদের বাবা ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ নুরুল আমিন। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। এরপর তারা নবম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন নিজেদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই সুইটি তিন পয়েন্টেরও বেশি পেয়ে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন তারা।

বিজ্ঞাপন

এ পর্যন্ত পৌঁছাতে নানা লড়াই ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তাসনিম আক্তার সুইটি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমরা অনেক কষ্ট করেছি। চোখে অন্য সবার মতো ভালো করে না দেখলেও পড়ালেখায় আমরা সবসময় মনোযোগী ছিলাম। বাবা নিঁখোজ হওয়ার পর পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও আমরা গ্রাম গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা আমাদের পড়ালেখা বন্ধ করিনি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্নের কথা জানালেন সুইটি।

আসমাউল হুসনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব ছিল প্রায় ছয় কিলোমিটার। পাবলিক বাসে চড়ে আমাদের যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কলেজে যেতে হতো অটোরিকশা কিংবা রিকশায়। কলেজে কষ্ট করে যাওয়া-আসা, অর্থের সংকটের মধ্যেও আমরা পিছপা হয়নি। আমাদের আজ এতদূর আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন আমাদের মা। খেয়ে না খেয়ে তিনি আমাদের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন বাড়ি থেকে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকেও বৃত্তির টাকা পেয়েছি। ওগুলো দিয়েই আমরা পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি।’

দুই মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে শুনে তিনদিন আগে গ্রাম থেকে এসেছেন তাদের মা ফরিদা বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার চার মেয়ে। তার মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি অনেক কষ্ট করে। ওদের বাবা নিঁখোজ হওয়ার পর সংসার সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ছোটবেলা থেকেই ওরা দুজন পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ায় তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করে দিই। এরপর থেকে এতদূর তারা নিজেদের চেষ্টায় এসেছে। তারা জীবনে আরো বড় হোক সেই কামনা করি।’

স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে পাস

দশ বছর আগে নগরীর মুরাদপুরে দৃষ্টিহীনদের বিশেষায়িত স্কুলে সহপাঠী ছিলেন মোহাম্মদ ফরিদ ও নয়নতারা আকতার। সেখানে নিজেদের মধ্যে হয় মন দেওয়া-নেওয়া। দুই বছর আগে বিয়ে করেন। এক বছর আগে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে। এর মাঝেও চালিয়ে যান নিজেদের পড়ালেখা। সরকারি আশেকানিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্বামী ফরিদ ৪ দশমিক ৮২ ও স্ত্রী নয়নতারা ৪ দশমিক ৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

মোহাম্মদ ফরিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেজাল্ট ভালো হয়েছে। দুজন একসাথে পাস করেছি, এটা বেশি ভালো লাগছে। ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যাব। যদি সম্ভব হয়, উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে দেশের জন্য কিছু করতে চাই, যাতে আমাকে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়।’

নয়নতারা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। চোখে কম দেখতে পেলেও পড়াশোনা থেকে আমাকে কেউ বিরত রাখতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে এতদূর এসেছি। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা আছে।’

ফরিদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকায় সংসার চলে। আর পড়ালেখা চলে সরকারি বৃত্তির টাকায়।

চোখ নয়, জ্ঞানের আলোয় জিপিএ-৫ সোহেলের

নেই চোখের আলো। তবে নিজের জ্ঞানের আলোতে নিজেকেই উজ্জ্বল করেছেন সোহেল রানা। সরকারি আশেকানিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পড়তে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হতে চান সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।

সোহেল রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজকের দিনটার জন্য অনেক কষ্ট করেছি। অবশেষে ফল পেলাম। আমি যাতে পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারি সেজন্য আমার বাবা-মা অনেক কষ্ট করেছেন। প্রতিমাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পাঠিয়েছেন, যাতে আমি শহরে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি। আর শিক্ষকরাও আমাদের পাশে না থাকলে হয়তো আমরা এত দূরে আসতে পারতাম না।’

‘এ+’ হাতছাড়া হলেও খুশি তুষার

চোখে আলো না থাকলেও শ্রুতিলেখকের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষায় শতভাগ উত্তর দিয়েছিলেন মোহাম্মদ তুষার। জিপিএ-৫ পাবেন আশা ছিল। চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি আশেকানিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে ৪ দশমিক ৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রথমে কিছুটা মন খারাপ করেছিলেন। তবে সীমাবদ্ধতা উৎরে সাফল্যের কথা ভেবে সেই অনুভূতি আর স্থায়ী হয় না।

অভাব অনটনের সংসারে জম্ম নেয়া তুষারের বাড়ি ফেনীর দাঁগনভূইয়ায়। বাবার ছিল কুলিং কর্ণার। চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। জম্ম দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা নিয়েই। কিন্তু পড়ালেখায় সক্ষমদের অনেকের চেয়ে এগিয়ে।

তুষার সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিপিএ-৫ পাব আশা করেছিলাম। পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেই হয়। বিসিএস পাশ করতে চাই, শিক্ষক হতে চাই। আমাদের মতো অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আছে যারা সমাজে অবহেলিত। তাদের জন্য কাজ করতে চাই।’

ছবি তুলেছেন: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আইসি/আরডি

এইচএসসি পরীক্ষা চট্টগ্রাম দৃষ্টিহীন

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর