প্রদর্শনীর আগেই ঝরে পড়ছে টিউলিপ, বাগান নিয়ে সংশয়
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:০৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাগরতীরে অবৈধ দখলে থাকা ১৯৪ একর ভূমি উদ্ধার করে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দন ‘ফুলের বাগান’ করার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই ঘোষণা দিতে ওই ভূমিতে আটদিনের ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, যার উদ্বোধন হবে আগামীকাল (শুক্রবার)।
উৎসবে প্রদর্শনের জন্য লাগানো হয়েছে হাজারো দেশি-বিদেশি ফুলের চারা, যার অধিকাংশই কৃত্রিমভাবে রোপণ করা এবং অস্থায়ী। প্রদর্শনের আগেই পাপড়ি ঝরে নির্জীব হয়ে পড়েছে অনেক টিউলিপ ফুলের গাছ। তবে সদ্য রোপণ করা যেগুলো সেগুলোকে অবশ্য হাসতে দেখা গেছে।
এই অবস্থায় প্রাণ-প্রকৃতি গবেষকরা সাগরতীরের ওই ভূমিতে আদৌ কোনো ফুলের বাগান করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দিহান। তারা বলছেন, লবণাক্ত মাটি ও আবহাওয়ায় লবণসহিঞ্চু উদ্ভিদ ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা অসম্ভব। এখন জেলা প্রশাসনও বলছে, মাটির গুণগত মান পরীক্ষার পর বাগানের বিষয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাটে উত্তর ছলিমপুর মৌজায় বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে বালুচর শ্রেণির ১৯৪ একর সরকারি ভূমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘শুকতারা’ নামের একটি রেস্তোঁরা। সেখানে মাদকের আড্ডাসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ ওঠার পর গত ৪ জানুয়ারি জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে রেস্তোঁরাটি উচ্ছেদ করে ভূমিগুলো অবমুক্ত করে।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্ধার করা সরকারি ভূমি যাতে পুনরায় দখল হতে না পারে সেজন্য ‘ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে থাকবে দেশি-বিদেশি দৃষ্টিনন্দন ফুলের সমাহার। ফুল বাগানের পাশাপাশি সেখানে জলাশয়ে থাকবে কায়াকিং ও এর পাড়ে ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে।
পর্যটন স্পট বানানোর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো দেশের সবচেয়ে বড় ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। আগামীকাল শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে এ উৎসব।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রদর্শনীতে ১২২ প্রজাতির তিন লাখেরও বেশি দেশি-বিদেশি ফুল গাছ থাকছে। এর মধ্যেই প্রায় দুই লাখ লাগানো হয়েছে। দেশি ফুলের মধ্যে আছে- হরেক প্রজাতির গাদা, মোরগঝুঁটি, ডালিয়া ও চন্দ্রমল্লিকা। বিদেশি ফুলের মধ্যে আছে- টিউলিপ, ইনকা মেরিগোল্ড, ফ্রেন্স মেরিগোল্ড, সেলোচিয়া, ভারভেনা, ডায়ানতাস, পেঞ্জিসহ আরও কয়েক প্রজাতি।
অধিকাংশ ফুলের গাছ বিভিন্ন নার্সারি থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হলেও প্রদর্শনীতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে জেলা প্রশাসনের।
বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে প্রদর্শনী প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখা গেছে, কোথাও সারিবদ্ধ, কোথাও গোলাকৃতি আবার কোথাও ফুলসহ গাছ দিয়ে আঁকা হয়েছে ‘হৃদয়’। বেশির ভাগ ফুলের গাছ নার্সারি থেকে পলিথিন মোড়ানো মাটিসহ এনে শুধুমাত্র সেখানে মাটি খুঁড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লাল-হলুদ-সাদা-মেরুণ নানা রঙের টিউলিপ ফুলের গাছে দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে। আবার এর বিপরীতে গাছের শাখায় শুকিয়ে থাকা টিউলিপ কিংবা ঝরে পড়া এর পাপড়ি অথবা নির্জীব গাছও দেখা গেছে অনেকগুলো। প্রদর্শনীর আগেভাগে সতেজ-সজীব টিউলিপ দেখাতে নার্সারি থেকে পিকআপ ভ্যানে করে আনা হচ্ছিল সারি সারি নতুন গাছ, দ্রুততার সাথে ‘মাটির তৈরি টব’ থেকে মাটিসহ গাছগুলো নিয়ে লাগানোও হচ্ছিল।
বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে যে টিউলিপ গাছগুলো লাগানো হয়েছিল, সেগুলো সরাসরি চারা বা গাছ এনে রোপণ করা হয়েছিল এখানকার (সাগরতীর) মাটিতে। এখানকার মাটি লবণাক্ত। সেজন্য শুরুর দিকের অনেকগুলো গাছই মারা গেছে। এখন আমরা টব থেকে মাটিসহ গাছ নিয়ে এখানে মাটি খুঁড়ে রোপণ করছি। লবণাক্ত মাটিতে এটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’
হানিফের দাবি, টিউলিপ বাঁচাতে সাগরতীরের মাটিতে সাদা পলিথিন বিছিয়ে এর ওপর অন্য জায়গা থেকে উর্বর মাটি এনে সেগুলোকে উপযোগী করে তারপর গাছ লাগানো হচ্ছে।
বাগান ও প্রদর্শনী তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মৌসুমে আমরা মাটিতে কিছু জৈবসার ব্যবহার করে এরপর ফুলের গাছ লাগিয়েছি। আগামী মৌসুমের আগে আমাদের পরিকল্পনা আছে, বিদ্যমান লবণাক্ত মাটি সরিয়ে উর্বর মাটি ঢেলে তারপর গাছ লাগানো হবে। এভাবে স্থায়ী বাগান গড়ে তোলা হবে।’
টিউলিপের বীজগুলো সরাসরি নেদারল্যান্ড থেকে এনে দেশে চারা উৎপাদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রদর্শনীতে ফুলের চারা সরবরাহের দায়িত্ব পাওয়া ফৌজদারহাটের ইফা নার্সারির স্বত্বাধিকারী কাউসার আল ইমরান।
স্থায়ী বাগানের উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি কোনো উদ্ভিদ বা ফুলের গাছ সরাসরি যদি আমাদের দেশে এনে লাগানো হয়, তাহলে সেটা কখনোই টিকবে না। এটি করার আগে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে মাঠ জরিপ করতে হবে। প্রকৃত পরিবেশে গড়ে ওঠা একটি উদ্ভিদকে অন্য পরিবেশে নিয়ে গেলে সেটা খাপ খাওয়াতে মিনিমাম দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমুদ্রের তীরে মাটি লবণাক্ত থাকে। সেখানকার আবহাওয়ায়ও লবণের প্রভাব থাকে। সাগর উপকূলে লবণাক্ত পরিবেশে যে বিশেষ শ্রেণির উদ্ভিদ জন্মায়, সেগুলোকে বিরূপ আবহাওয়া সহিঞ্চু বা হ্যালোফাইট উদ্ভিদ বলে। যেমন- সুন্দরী, গরান, হেতাল, গোলপাতা ইত্যাদি। তাই দেশীয় ফুল কিংবা বিদেশি ফুলের বাগান কোনো ধরনের প্রাক সমীক্ষা ছাড়া সমূদ্র তীরে করলে আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি না সেটা অনেক বড় প্রশ্ন।’
গবেষকরা বলছেন, কৃত্রিম পদ্ধতিতে এনে ফুলের গাছ লাগিয়ে ক্ষণিকের জন্য প্রদর্শনী করা যাবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো বাগান তৈরি সম্ভব নয়। প্রাক সমীক্ষা ছাড়া বাগান করতে গেলে শুধু অর্থের অপচয় হবে।
ইফা নার্সারির স্বত্বাধিকারী কাউসার আল ইমরান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেদারল্যান্ড থেকে সরাসরি টিউলিপের বীজ এনে আমরা প্রথমে এখানে বীজতলা করেছি। সেখানে যেসব টিউলিপ ফুলের গাছ হয়েছে, সেগুলো আমরা সাগরতীরের মাটিতে এনে লাগিয়েছি। সর্ব্বোচ্চ ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটা টিকে থাকে। এখন একটু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেকগুলো গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে মাটিও লবণাক্ত। আমরা লবণাক্ত মাটির ওপরে বেলে-দোআঁশ মাটির স্তর তৈরি করেছি। সেখানে ওয়াসার অলবণাক্ত পানি ছিটিয়েছি। ১০ হাজার লিটার পানির ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে। সাগরের লবণাক্ত পানি গাছের সঙ্গে সংযুক্ত না হলে কোনো সমস্যা হবে না।’
তবে বর্ষায় সাগরে যখন উত্তাল ঢেউ হবে, প্রচণ্ড ঢেউয়ে তীরের বাগান তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
এ প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাগান করার আগে অবশ্যই তীর উঁচু করতে হবে। এটা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।’
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম