অমর একুশে ‘সর্বজনীন’ মেলা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৫৭
অমর একুশে বইমেলার নবম দিন বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ৭টা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসিসংলগ্ন গেট দিয়ে পাঞ্জাবি-পাজামা ও টুপি পরা চার শিক্ষার্থী বের হচ্ছেন। চার জনের হাতেই বই। হাঁটার গতি দেখে মনে হলো তাদের তাড়া আছে।
অমর একুশে বইমেলা আমার কোনো স্টল নেই, নেই কোনো প্যাভিলিয়ন। সুতরাং বইমেলায় শত কোটি টাকার বই বিক্রি হলেও আমার কিছু যায় আসে না। আবার একেবারে বিক্রি নাহলেও আমার কিছু যায় আসে না। তার পরও আমার দৃষ্টিতে মেলার সব চেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে- মানুষের হাতে হাতে বই। যে হাতগুলোতে বই থাকে, সেই হাতগুলোকে শ্রেষ্ঠ হাত মনে হয়।
সে কারণেই কারও হাতে বই দেখলে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেত ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে তাদের পাঠাভ্যাস এবং রুচি সম্পর্কে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এটা আমার জন্য জরুরিও বটে। কিন্তু, বইমেলাব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত ইউটিউব চ্যানেল, জাতীয় দৈনিকগুলোর বাইপ্রোডাক্ট অনলাইনের বুমওয়ালা ভিজুয়াল টিম, সর্বোপরি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্যামেরার সামনে কথা বলার সহজলভ্য সময়ে এসে প্রিন্ট মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজপোর্টালকে সময় দিতে অনেকেরই অনীহা। ‘কোন চ্যানেলে কখন দেখা যাবে’— এই কমন প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারেল কেউ আর এখন কথা বলতে চায় না।
তো যা বলছিলাম, চারজন ছাত্র দ্রুতপদে মেলা থেকে বের হচ্ছিলেন। চার জনের হাতেই বই। কাছে গিয়ে একটু সময় চাইলাম। চারজনই দাঁড়ালেন।
কোথা থেকে আসছেন?— আমরা মিরপুর-১ নম্বরের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স থেকে এসেছি। আমরা আরবি সাহিত্যে পড়ি। কওমি ভাষায় এটাকে ‘আদব’ বলে। বাংলাদেশ, সৌদি আরব, মিশর, পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের বড় বড় আলেমের লেখা বই আমাদের পড়ানো হয়। তবে মূল বিষয় হচ্ছে কোরআন ও হাদিস।
যিনি কথাগুলো বললেন, তার নাম সালমান আহমাদ। তার সঙ্গে থাকা অপর তিন জনের নাম মো. হাসান, মো. আব্দুল্লাহ এবং নূর মুহাম্মদ।
চার জনের হাতেই অমর একুশে বইমেলার করপোরেট পার্টনার বিকাশ’র লোগোওয়ালা ব্যাগ। মেলার প্রায় প্রতিটা স্টল ও প্যাভিলিয়নে এই ব্যাগ সরবরাহ করেছে বিকাশ। দুই জনের ব্যাগে থাকা বই বেশ মোটা-শোটা। অপর দু’জনের ব্যাগে থাকা বই হাল্কা-পাতলা। ধারণা করছিলাম, কোনো ধর্মীয় বই অথবা সিরাতগ্রন্থ কিনেছেন কওমি মাদরাসার এই চার শিক্ষার্থী।
বইগুলো দেখতে চাইলে প্রথমেই সালমান আহমাদ তার ব্যাগ থেকে বই বের করলেন। বই দেখার পর বিস্ময় আর কাটে না আমার। হঠাৎ করে যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম! ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম পুরুষ আহমদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ কিনেছেন তিনি।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে রচিত অঙ্কার উপন্যাস কিনেছেন জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম কওমি মাদরাসার ছাত্র সাদমান আহমাদ!
এ বই নিয়ে মাদরাসায় গেলে শিক্ষকরা কিছু বলবেন না?— না, বলবেন না। শিক্ষকরা আমাদের বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার পরামর্শ দেন। যেহেতু আমরা সাহিত্যের ছাত্র, সে কারণে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য পড়তে আমাদের কোনো বাধা নেই।
সালমান আহমাদ উপন্যাস কিনলেও মো. হাসান ও নূর মুহাম্মদ কিনেছেন বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ আর মো. আব্দুল্লাহ কিনেছেন ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’।
জীবনে প্রথম বারের মতো বইমেলায় আসা এই তিন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মেলা কেমন লাগল, মেলা নিয়ে কোনো অভিযোগ আছে কিনা, মেলার পরিবেশ কেমন?
তিনজন ছাত্রই জানালেন— মেলা অনেক ভালো লেগেছে তাদের। মেলা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। তবে তরুণ ইসলামী লেখকদের বই খুঁজে পাওয়া যায়নি মেলায়। আর মেলার অস্থায়ী মসজিদে জুতা রাখার র্যাক না থাকায় আজও একজনের জুতা হারিয়েছে। এদিকটা যেন কর্তৃপক্ষ নজর দেয়।
পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ পর অমর একুশে বইমেলা আরেকটি সর্বজনীন উৎসব। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে কারও কারও এলার্জি থাকলেও অমর একুশে বইমেলা নিয়ে কোনো পক্ষের কোনো আপত্তি নেই। বইমেলার শুরু থেকেই সব মত-পথ ও বিশ্বাসের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেলায় আসছে এবং দ্বিধাহীন ও আনন্দচিত্তে বই কিনছে, ঘুরছে-ফিরছে উপভোগ করছে।
শুধু মিরপুর-১ নম্বরের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স থেকে নয়, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য তালিবে ইলম অমর একুশে বইমেলায় আসেন এবং পছন্দের বই কিনে বাসায় ফেরেন। এ কারণে, অন্যান্যা বইয়ের পাশাপাশি অমর একুশে বইমেলায় বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় বইও বিক্রি হতে দেখা যায়।
বাংলা প্রকাশের অ্যাসিটেন্ট ম্যানেজার নুরুন নবী বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেলায় বরাবরই ধর্মীয় বই এবং বাচ্চাদের বই বেশি বিক্রি হয়। আমাদের প্যাভিলিয়নে ইসলামি বই এবং শিশুতোষ বইয়ের কর্নার থেকে বেশি ক্যাশ স্লিপ কাটা হয়।’
বইমেলা থেকে প্রতিদিনই কিছু আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরার তাগিদ থাকে বৈকি! শূন্য হৃদয়ে বইমেলা থেকে ফিরলে বইমেলার মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। সে কারণেই হয়তো মেলা থেকে বের হওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ফটকে উন্মুক্ত লাইব্রেরি চত্বর থেকে ভেসে এলো- ‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো/সহেনা পরানে গো/একেলা ঘরে রইতে পারিনা/আমার বন্ধুয়া বিহনে গো/সহেনা পরানে গো/একেলা ঘরে রইতে পারিনা/ বসন্তরই কালে/ডালিম পাকা ডালে/বসন্তরই কালে/ডালিম পাকা ডালে/কার কুঞ্জে রইয়াছে তুমি/আইলায় আইলায় আইলানা/কার কুঞ্জে রইয়াছে তুমি/আইলায় আইলায় আইলানা/একেলা ঘরে রইতে পারি না।’
তাড়া থাকলেও কিছু সময়ের জন্য দাঁড়াতে হলো উন্মুক্ত লাইব্রেরি দিবস-১৪২৯ উপলক্ষে আয়োজিত এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হঠাৎ ডান দিকে তাকিয়ে দেখি- আধো আলো, আধো ছায়ায় দাঁড়িয়ে মরমি সাধক কফিল উদ্দিন সরকারের কালজয়ী এই গান উপভোগ করছেন সেই চার শিক্ষার্থী, যাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে মেলার গেটে কথা হল। এ দৃশ্য আনন্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: কবীর চৌধুরী’ এবং ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহুর হোসেন চৌধুরী‘ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবদুস সেলিম ও জাহীদ রেজা নূর। আলোচনায় অংশ নেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, খায়রুল আলম সবুজ, মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং মুস্তাফিজ শফি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শফি আহমেদ।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, এক জীবনে কত যে বিপুল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা যায় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কবীর চৌধুরী। তিনি বাংলা-ইংরেজিতে যেমন মৌলিক লেখা লিখেছেন তেমনি অনুবাদও করেছেন। তার জীবদ্দশায় কমপক্ষে দশটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবীর চৌধুরী যথার্থ অর্থেই জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন সবারই শিক্ষক হবার গুণসম্পন্ন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে, সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের লড়াইয়ের কালটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যৌবনে বামধারার প্রতি আকৃষ্ট জহুর হোসেন চৌধুরীর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুনিষ্ঠতাকে হেয় না করে সত্যকে তুলে ধরা।
সভাপতির বক্তব্যে শফি আহমেদ বলেন, ‘কবীর চৌধুরী এবং জহুর হোসেন চৌধুরীকে স্মরণ আমাদের জাতিগত কর্তব্য। তারা যে প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের সবার জন্য ইতিবাচক সমাজ গড়ার সংগ্রাম করেছেন; তা আজকের প্রজন্মকে স্মরণে রাখতে হবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মালেক মাহমুদ, সুপা সাদিয়া, খান মুহাম্মদ রুমেল, গিরীশ গৈরিক। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বিমল গুহ, স্নিগ্ধা বাউল এবং রমজান মাহমুদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রাজিয়া রহমান, জাহান বশির এবং এ এস এম সামিউল ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন- শিল্পী কাঙ্গালিনি সুফিয়া, আব্দুর রহমান, বশির উদ্দিন সরকার, সুভাষ বিশ্বাস, কোহিনুর আক্তার গোলাপী, মো. নূরুল ইসলাম, বিমল বাউল, সুধীর মণ্ডল, অমিয় বাউল।
যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন পুলিন চক্রবর্তী (তবলা), মো. রিফাত হোসেন (কী-বোর্ড), রনজিৎ কুমার বৈরাগী (দোতারা), গাজী আব্দুল হাকিম (বাঁশি) এবং মো. হাসান মিয়া (বাংলা ঢোল)।
আগামীকাল অমর একুশে বইমেলার দশম দিন। মেলা শুরু হবে সকাল ১১ টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। আগামীকাল থাকছে শিশুপ্রহর। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে। এছাড়া অমর একুশে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে ৮ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করবেন শিল্পী হাশেম খান। সকাল সাড়ে ৯ বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তেন শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ এবং জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: এস এম সুলতান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মলয় বালা এবং সৈয়দ নিজার। আলোচনায় অংশ নেবেন সুশান্তকুমার অধিকারী, ইমাম হোসেন সুমন, নাসির আলী মামুন এবং নীরু শামসুন্নাহার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মুনতাসীর মামুন।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম