৮ বার পিডি বদল সময় বেড়েছে ৩ বার, শেষই হচ্ছে না রেলের প্রকল্প
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩২
ঢাকা: একবার, দুইবার নয়, তিনবার বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ। প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে আট বার। তারপরেও কাজ শেষ করতে না পেরে আরেক দফা অর্থাৎ চতুর্থবারের মতো মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪শ কোটি টাকা বাড়ানোরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসেছে নতুন প্রকল্প পরিচালকও। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া-লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ার পেছনে করোনার পাশাপাশি ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ’র বাধা রয়েছে। তবে এ বাধা মাথায় নিয়েই আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি ৭২ কিলোমিটার রেলপথের ৩২ কিলোমিটার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে রেলওয়ে।
আখাউড়া- লাকসাম প্রকল্প: বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র অনুযায়ী— ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত মোট ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক বৈঠক প্রকল্পটি অনুমোদন হলেও ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া-লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এরমধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কাজে পিছিয়ে যাওয়ায় মেয়াদ আরেক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে তৃতীয়বারের মতো মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ফলে এই প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রেলওয়েতে। একই সঙ্গে ৪শ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে— ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওই প্রস্তাবে রাজি নয় অর্থদাতা সংস্থা। তারা মেয়াদ, অর্থ কোনোটিই বাড়াতে চায়না। সূত্রানুযায়ী, আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের রুট ৭২ কিলোমিটার। এর ট্র্যাক হলো ১৪৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া ইয়ার্ড, লুফ লাইনসহ মোট ১৮৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার নির্মাণ করা হবে। লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান। যে কারণে এখন সিঙ্গেল লাইনে ট্রেন চলাচল করছে। বর্তমান লাইনটিতে ট্রেনের স্বাভাবিক গতি ৮০ কিলোমিটার থাকলেও ট্রেন চালাতে হয় সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে। ফলে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা দেরি হয়।
এক প্রকল্পে আট পরিচালক: প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৪ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন আট জন। শুরুতে লাকসাম- আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী। তারপরে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. লিয়াকত আলীকে। তৃতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পান মোজাম্মেল হক। চতুর্থ পিডি ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। পঞ্চম পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. আরিফুজ্জামান, ষষ্ঠ পিডি ছিলেন রেলের তখনকার যুগ্ম মহাপরিচালক ( প্রকৌশল) রমজান আলী। সপ্তম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. শহিদুল ইসলামকে। তিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক ( অবকাঠামো) পদোন্নতি পাওয়ায় সম্প্রতি এই প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় এমডি সুবক্তগাইনকে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা: আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ ডুয়েল গেজ লাইনের কাজ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাকস্ট্রাকচারসহ যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ( সিটিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার)। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি ঋণ দিচ্ছে ৪ হাজার ১১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যংক-ইআইবি ১ হাজার ৩৫৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাকি ১ হাজার ২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করছে। এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিটিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার এর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সারাবাংলাকে জানান, সবচেয়ে বড় বাধার সৃষ্টি করছে বিএসএফ। কাজ এগিয়ে নেওয়ার অনেক পরে তারা অভিযোগ করেছেন যে শূন্য রেখার দেড়শ গজের মধ্যে কাজ করা হচ্ছে। তারা শুরুর দিকে বললে কাজটা এতটা পিছিয়ে যেত না।
তিনি বলেন, ‘ওই অংশে তাদের অনেক যন্ত্রাংশ দীর্ঘ সময় পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে।’
বাস্তবায়নে বাধা: জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা কাজ প্রায় বন্ধ রাখা হয়। এরমধ্যে দ্বিতীয় দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। বাকি কাজ বাড়তি মেয়াদেও শেষ করতে না পেরে আরেক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা এলাকায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাঁধ সেঁধে বসেছে। তাদের বাধার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ডাবল লাইন, দুই স্টেশন ও একটি সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ রয়েছে। শূন্যরেখায় ১৫০ গজের ভেতরে কাজ হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে বিএসএফের পক্ষ থেকে। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করা হয়। সবশেষ গত আগস্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভারত সফরেও বিষয়টি আলোচনা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলজংশন থেকে লাকসাম রেলজংশন পর্যন্ত ডাবল লাইনের কাজ চলছে। আখাউড়া থেকে শশীদল পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ, ৬টি রেলওয়েস্টেশন, সেতু, কালভার্ট তৈরির কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিস্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন। বন্ধ থাকা কাজ চালুর লক্ষ্যে গত বছর স্থানীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপরই জটিলতা নিরসনে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার পর ওইসব স্টেশন ও সেতুর কাজ শুরু হয়। কিন্তু তিন দিনের মাথায় আবার বাধা আসায় সেই থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে।
যতটুকু এগিয়েছে: ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২১ কিলোমিটার রেলপথের ১১৮ কিলোমিটার রেলপথ আগে থেকেই ডাবল লাইন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ১৩১ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ৭২ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েল গেজ লাইনে উন্নীত করার জন্য লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা গত ৮ বছর ধরে চলছে। অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্প গত ৮ বছরে মাত্র ৩২ কিলোমিটার রেলপথের কাজ শেষ করতে পেরেছে। বাকি ৪২ কিলোমিটারের কাজ চলমান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কাজের অগ্রগতি ৯০ ভাগ।
রেলপথমন্ত্রী যা বলেছেন: এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে জানান, আখাউড়া-লাকসাম অংশের কাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরো রেলপথ ডাবল লাইন হয়ে যাবে। এ প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য ৪ সদস্যের একটি টিম কাজ করছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নতুন প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য: সাবেক প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) হওয়ার পর শূন্য হয়ে পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া-লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালকের পদ। সম্প্রতি ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এমডি সুবক্তগাইনকে।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা আবার বিএসএফের বাধার মতো জটিলতার কারণে ৭২ কিলোমিটার রেললাইনের মাত্র ৩২ কিলোমিটারের কাজ শেষ করা গেছে। এই ৩২ কিলোমিটার আমরা দ্রুত উদ্বোধন করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘বাকি ৪০ কিলোমিটার দ্রুত শেষ করার জন্য জটিলতা দূর করে কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ হয়ত কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু এ প্রকল্পে আর নির্মাণ ব্যয় বাড়বে না।’
এদিকে প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করেই মাঝপথে উদ্বোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক জানান, আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পের ৭২ কিলোমিটার পথের ৩২ কিলোমিটার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে রেলওয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। সে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
সারাবাংলা/জেআর/একে