‘খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাব না’
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১০
ঢাকা: ‘আমার ছেলেকে তো আর ফেরত পাবো না, এজন্য বিচার চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমার একটাই কথা ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার মৃত্যুর আগে হলেও দেখে যেতে চাই সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার। আমি এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাইনি। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেদিন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখবো, বিচার দেখে যেতে পারবো, ওইদিন কবর জিয়ারত করবো। এর আগে যদি আমার মৃত্যুও হয়, তবুও হক। এরপরেও খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাব না।’
ছেলের খুনের কথা স্মৃতিচারণ করে সারাবাংলা’কে এসব কথা বলেছেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ার মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টার ফলাফল ১১ বছর পরও শূন্য রয়েছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১১ বছর ধরে চার্জশিট জমা দিতেই পারলেন না আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘একের পর একের মামলার তদন্ত আসে আর যায়, কিন্তু চার্জশিট জমা হয় না। করোনাভাইরাসের আগে এক র্যাব কর্মকর্তা যোগাযোগ করেছিলেন, এর বাইরে গত ২/৩ বছর ধরে আর কেউ যোগাযোগ করেননি।’
এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সব সম্ভব। উনি বললেই সব হবে।’
মা সালেহা মনির বলেন, ‘মায়ের মন তো, সবসময় মনে হয় কালকেই আমার ছেলে সগর চলে (মৃত্যু) গেলো। আমার ছেলে এভাবে মারা যাবে, চলে যাবে কল্পনা করতে পারেনি। আবার মামলা যে এতো দেরি হবে এই সরকারে আমলেই সেটাই ভাবতে পারেনি। র্যাব তো সব জানে, প্রতিবেদন জমা দিলেই হয়। সোজা কথা আমার ছেলের খুনিকে দেখে যেতে চাই। তাদের শাস্তি হবে কিনা জানি না। তবে খুনিদের দেখে যেতে চাই, কেন আমার ছেলেকে খুন করলো, কিসের জন্য করেছে? একটা মায়ের মনে আর কি আকুতি থাকতে পারবে। খুন হওয়া ১২ বছর হতে চললো। কত খুনের বিচার হচ্ছে, ক্লু-লেস কত মামলায় বিচার হচ্ছে। ৩০/৩৫ বছর পরও মামলার বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় এমন হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য নয়।’
সাগর-রুনি হত্যার ১০ বছর— ‘খুনিরা কি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী?’
নিহত মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ‘আমাদের আর কি বলার আছে, বিচার চাওয়া ছাড়া। মামলার কোনো অগ্রগতি নেই, সব আগের মতই চলছে। আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও খুব একটা যোগাযোগ নেই। যাই হোক মামলার বিচারটাই চাই, আর কিছুই চাওয়ার নেই।’
‘তবে রুনির ছেলে মেঘ এখনও তার মায়ের কথা বলে। আমরা প্রতি সপ্তাহে একবার করে কবর জিয়ারত করতে যাই। মেঘ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে দেখা যায় তার বাবা-মায়ের ছবি নিয়ে বসে থাকে। তাদের সে দেখে’, বলেন নওশের আলম।
সাগর-রুনি হত্যা মামলায় সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রশিদুল আলমের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন। এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৯৫ দফা সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথম ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম তদন্ত ভার নেন। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ বছরের ২১ মার্চ তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার ৮ আসামির দুই জন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে রয়েছেন। অপর ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিল ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার ৮ জনের কেউই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান- এই ৫ জনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এখন পর্যন্ত মামলায় ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব।
মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। এটি একটি আলোচিত মামলা। তাই সময় লাগছে।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে নারাজ বলে জানান তিনি।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, ‘দীর্ঘদিনেও মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না। আসামিদের তো আদালতে হাজিরা দিতেই হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে তারা অপরাধী হলে সাজা পেতো, আর অপরাধী না হলে ছাড়া পেতো। আমরা আশা করি, আলোচিত এ মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের বছর ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনি নিজ ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু গত ১১ বছরে খুনি তো দূরের কথা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনই দাখিল করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সারাবাংলা/এআই/এমও
খুনি ছেলের কবর জিয়ারত সাগর-রুনি সাগর-রুনি হত্যা সাগর-রুনি হত্যা মামলা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড