Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বইমেলার পরতে পরতে মানবতার জয়গান

আসাদ জামান
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:২৯

অমর একুশে বইমেলার ১১তম দিন শনিবার। মেলার শিশু চত্বর ঘুরে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে রওনা হওয়ার সময় স্মার্ট এক তরুণী এসে বললেন, ‘স্যার, একটু কথা বলতে পারি?’ কেউ কথা বলতে চাইলে তাকে সময় দেওয়া ন্যূনতম ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। তবে কেউ যদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কথা বলতে চায়, তাহলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া খুব বেশি দোষের নয়।

তরুণীটি ছিলেন বিকাশের পলোশার্ট পরা। তাই কোনো প্রকার ভূমিকায় না গিয়ে বললাম, ‘আমার বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে এবং এটা সক্রিয়।’

বিজ্ঞাপন

তরুণীটি বললেন, ‘স্যার, আমি বিকাশ অ্যাকাউন্ট নিয়ে কথা বলব না। বিকাশের পক্ষ থেকে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বই কালেক্ট করছি। আপনি যদি একটা বই কিনে দিয়ে এই কাজে অংশ নিতেন…।’

কেন নয়? নিশ্চয়ই! তবে আমার একটু তাড়া আছে। আমি টাকা দিয়ে দিই আপনি একটু কষ্ট করে কিনে নিন। ‘না স্যার, এটা আমাদের প্রসিডিউর না। কষ্ট করে আপনিই কিনে দিন।’

অতঃপর পাশের স্টল থেকে খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের একটা শিশুতোষ গ্রন্থ কিনে দিয়ে তরুণীটির স্মিত হাসি পকেটে পুরে নিজ গন্তব্যে ছুটলাম।

ছুটে চলার সময় মনের মধ্যে দারুণ একটা প্রশান্তি কাজ করছিল। প্রশান্তিটা শুধু এই জন্য নয় যে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বই কিনে দিতে পেরেছি। প্রশান্তিটা আরেকটা জায়গা থেকেও। আচ্ছা, তরুণীটা তো পারতেন, ১০ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাঁচ জনের টাকায় বই কিনে বাকি পাঁচ জনের টাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ফুচকা খেতে! এই নষ্ট সময়ে, পচে যাওয়া সমাজে, নির্লজ্জ মানসিকতার যুগে এটা কি খুব কঠিন ছিল তার জন্য? কিন্তু নগদ টাকা গ্রহণ করেননি তরুণী। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের প্রশ্নে অটল-অবিচল থেকে দাতাকে দিয়েই বই কিনিয়ে নিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

কে জানে, একদিন এই তরুণীই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখা-পড়া শেষ করে প্রজাতন্ত্রের বড় কর্মচারী (আমরা যাকে বলি ডাকসাইটে আমলা) হয়ে ঘুষ ছাড়া ফাইল ছাড়বেন না। আজকের এই সততা, অটল-অবিচল ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জের মতো সেবা প্রার্থীর দিকে হাত পেতে দেবেন। অবশ্য যাদের ‘বর্তমান’ এত সুন্দর তাদের ভবিষ্যৎ অত নোংরা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

যেদিনটা ভালো দিয়ে শুরু হয়, সেদিনটা শেষ পর্যন্ত ভালোই যায়। সন্ধ্যায় বইমেলার বঙ্গবন্ধু চত্বরে হেলথ্ চেকআপ পয়েন্টে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন তরুণ স্বেচ্ছায় রক্ত দিচ্ছেন। তাদের এই রক্ত হয়তো আর্তমানবতার সেবায় কাজে লাগবে। হয়তো বা কোনো মুমূর্ষু রোগীর বেঁচে থাকার উছিলা হিসেবে কাজ করবে।

মেলায় টিএসসিসংলগ্ন গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় আরেকটি অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ল। তিন পথশিশুকে ডেকে নিয়ে এক ব্যক্তি মার্কস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্যাভিলিয়ন থেকে মার্কস জুনিয়র স্ট্রবেরি মিল্কশেক কিনে দিচ্ছেন। ১০৫ টাকায় কেনা ওই তিনটি মিল্কশেক প্যাকেট তিন পথশিশুর হাতে তুলে দিয়ে কী পরিমাণ প্রশান্তি নিয়ে ওই ব্যক্তিটি ঘরে ফিরছেন, সেটা শুধু তিনিই অনুভব করবেন। এটা বর্ণের পর বর্ণ সাজিয়ে, শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বাক্যবন্দি করা যাবে না।

এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে চাইলে ওই ব্যক্তিটি বললেন, ‘এই ছোট্ট একটা কাজের জন্য যদি আমার নাম-ধাম মিডিয়ায় প্রচার করে দেন, তাহলে এটা অর্থহীন হয়ে যাবে। আমি এগুলো করি আত্মার প্রশান্তির জন্য। আমার আত্মার প্রশান্তি আপনি নষ্ট করবেন কেন?’ ভদ্রলোকের কোনো কথারই জবাব দিলাম না। শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

ছুটির দিনে বইমেলার উপচেপড়া ভিড়ের মধ্যে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে। কোনোটি চোখে পড়ে। কোনোটি চোখ এড়িয়ে যায়। বইমেলায় যেহেতু সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যা বেশি, সেহেতু মানবতার জয়গানও এখানে বেশি ধ্বনিত হয় বৈকি!

শুক্রবারের মতো শনিবারেও কবি-সাহিত্যিক-লেখক-প্রকাশক, পাঠক ও সাধারণ দর্শনার্থীদের ঢল নামে বইমেলায়। সন্ধ্যার পর বইমেলার প্রতিটা স্টল-প্যাভিলিয়নের সামনে হাজার হাজার লোকের সমাগম চোখে পড়ে। লোকজনের এই ভিড় বইবিক্রিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা ইউসুফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল এবং আজ প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে। মেলায় যেদিন লোকজন বেশি আসে, সেদিন বিক্রিও বেশি হয়। শুক্র-শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় কর্মজীবী মানুষেরা মেলায় আসে এবং বই কেনে। বাকি পাঁচ দিন মূলত, তরুণ-তরুণীরা মেলায় আসে এবং ঘুরে-ফিরে বাসায় চলে যায়।’

মোহম্মদপুর থেকে মেলায় আসা সৈয়দ নাজিমুদ্দীন হাশেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে জব করি। ওয়ার্কিং ডে-তে বইমেলায় আসার সুযোগ নাই। ইংরেজি ভাষায় লেখা কিছু বই প্রয়োজন ছিল, সেগুলো কিনতে আজ মেলায় এসেছি। বইমেলার আয়োজন চমৎকার লেগেছে। কিন্তু প্রবেশপথের পরিবেশটা ভালো লাগেনি।’

মেরুল বাড্ডা থেকে মেলায় আসা আয়শা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম ছুটির দিনে মেলায় গেলে রাস্তায় জ্যাম কম পাওয়া যাবে। কিন্তু কাকরাইল মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ মোড়ের জ্যাম এবং সর্বশেষ টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশ পথে রিকশা-ভ্যান, দোকান-পাঠ ও ব্যক্তিগত গাড়ির দৃষ্টিকটু এবড়ো-থেবড়ো পার্কিং সব আনন্দ মাটি করে দিয়েছে। কিন্তু বইমেলায় ঢোকার পর মন ভালো হয়ে গেছে। কারণ, মেলার ভেতরটা সুন্দর।’

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

সকাল ১০ টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তেন শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ২০০ শতাধিক প্রতিযোগী অংশ নেয়। বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ : আশরাফ সিদ্দিকী’ এবং ‘স্মরণ সাঈদ আহমদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইয়াসমিন আরা সাথী এবং মাহফুজা হিলালী। আলোচনায় অংশ নেন উদয়শংকর বিশ্বাস, শামস্ আল দীন, রীপা রায় এবং আব্দুল হালিম প্রামাণিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খুরশীদা বেগম।

প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন প্রথিতযশা লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক এবং বিশ্লেষক। তিনি বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ফোকলোর চর্চায় ভিন্নতার অনুসন্ধান করেছেন। ফোকলোরের নানা অনুষঙ্গ বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে সাঈদ আহমদ বাঙালি হয়েও একজন বিশ্বমানব ছিলেন। বাংলা এবং ভারতীয় সংস্কৃতি তো বটেই বিশ্বের প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তার সব থেকে বড় অবদান, তিনি বিদেশি সাহিত্য আঙ্গিক দেশে এনেছেন এবং দেশের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

সভাপতির বক্তব্যে খুরশীদা বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বরেণ্য দুজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং সাঈদ আহমদ। তাদের জীবন, কর্ম ও আদর্শ আমাদের তরুণ সমাজকে পথ দেখাবে। এই গুণী ব্যক্তিদেরকে স্মরণ করা আমাদের জন্য একান্ত জরুরি।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মুর্শিদা বিনতে রহমান, রমজান মাহমুদ, ইশরাত তানিয়া এবং কবির কল্লোল।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি হারিসুল হক, রিশাদ হুদা, শেলী সেলিনা, আসাদউল্লাহ এবং জরিনা আখতার। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার, মো. মাসকুর-এ-সাত্তার, বেলায়েত হোসেন এবং সায়েরা হাবীব। এছাড়াও ছিল জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠন’এবং অমিত হিমেলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমস্বর’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন রওশন আলম, অনাবিল ইহসান, মামুনুল হক সিদ্দীক, জুলি শারমিলী, ফারহানা আক্তার, মো. রবিউল হক, আরতি রানী সেন এবং জয় চক্রবর্তী।

যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন প্রিয়ব্রত চৌধুরী (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কি-বোর্ড), শেখ আবু জাফর (বাঁশি), অরূপ কুমার শীল (দোতরা)।

আগামীকাল অমর একুশে বইমেলার ১২তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: হাসান হাফিজুর রহমান’ এবং ‘স্মরণ: হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মিনার মনসুর এবং শেখ মো. কাবেদুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেবেন শোয়াইব জিবরান, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, রুবেল আনছার এবং ওবায়েদ আকাশ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন এ.এইচ.এম. লোকমান।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

বইমেলা ২০২৩ বাংলা একাডেমি মানবতার জয়গান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর