Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বইমেলায় ‘গজাল’ দর্শন

আসাদ জামান
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:৩০

অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের বঙ্গবন্ধু চত্বরে ‘হাতে খড়ি’ নামক যে উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য বা হেতু কী হতে পারে? বইমেলা কর্তৃপক্ষ হয়তো ভেবেছিল, যারা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় আসবেন, তারা এই মঞ্চটাকে হাতে খড়ির জন্য ব্যবহার করবেন।

সাধারণত হাতেখড়ি কথার শাব্দিক অর্থ হাতে খড়িমাটি। এর আভিধানিক অর্থ শিশু বা নতুন শিক্ষার্থীর হাতে খড়ি দিয়ে লিখতে শেখানোর অনুষ্ঠানবিশেষ। আলংকারিক অর্থে আনুষ্ঠানিক শিক্ষারম্ভ বা কোনো কাজের আনুষ্ঠানিক সূচনা পর্ব।

কিন্তু গত ১২ দিনে এই মঞ্চে এ ধরনের কোনো কর্ম সম্পাদন হতে দেখা যায়নি। প্রতিদিন যেটা দেখা গেছে, সেটা হলো— নানা বয়সের, নানা ওজনের, নানা কিসিমের, নানা রঙের, নানা ঢংয়ের এবং রুচি বিবর্জিত মানুষের সেলফি উৎসব। যে জায়গাটাতে শিশু বা নতুন শিক্ষার্থীর হাতে খড়ি দিয়ে লিখতে শেখানোর কথা, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মুখ ভেংচিয়ে, দাঁত কেলিয়ে কদর্য ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে ছোট-বড়, বুড়ো-বুড়ি সবাই। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো অভিভাবক বাচ্চার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হাতে খড়ি মঞ্চে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে বাধ্য করছে।

নিত্যদিনের এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বিরক্তির চরম পর্যায়ে এসে মেলার ১২তম দিনে ষাট ছুঁই ছুঁই এক ব্যক্তিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, এই মঞ্চ কি সেলফি তোলার জন্য? এটা তো বাচ্চাদের হাতে খড়ির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আপনারা ওটার উপর উঠে সেলফিবাজি করছেন কেন?’

প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই তার সঙ্গে থাকা আরও তিনজন কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কে? সবাই তো এখানে উঠে সেলফি তুলছে, ছবি তুলছে। কিসের হাতে খড়ি?

গজাল টাইপের চার ব্যক্তির জোটবদ্ধ আক্রমণ দারুণভাবে উপভোগ করলাম। কথা বাড়ালে হয়তো বইমেলার পরিবেশটাই নষ্ট হতো। বিষয়টা তো এরকম নয় যে, বইমেলায় যারা আসে, তারা সবাই শুভবুদ্ধির, শুভচিন্তার, দৃষ্টিভঙ্গিও মননশীল বইয়ের পাতার মতো।

টানা দুই দিন ছুটির ধকল কাটিয়ে রোববার বইমেলা ছিল অনেকটাই নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট। এদিনও যথারীতি মেলার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট পাশের প্রবেশ পথ বন্ধ রেখে মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ উপহার দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ পাশ দিয়ে যারা মেলায় প্রবেশের জন্য এসেছিলেন, তাদেরকে উঁচু-নিচু, খানা-খন্দ, ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে পৌনে এক কিলোমিটার হেঁটে মন্দির পাশের গেট দিয়ে ঢুকতে হয়েছে।

সেগুনবাগিচা থেকে বয়স্ক মা এবং ছয় বছর বয়সী কন্যা শিশুকে নিয়ে রমনা কালি মন্দির এবং শিশু একাডেমির পেছনে অব্যবহৃ, সংকীর্ণ, অনিরাপদ এবং গাজাখোরদের আড্ডাবহর পার হয়ে এক নারীকে মেলায় ঢুকতে হয়েছে। কালী মন্দির পুকুর পারে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ওই নারীর।

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম এ পাশের গেট খোলা। এসে দেখি বন্ধ। ওখানে যারা ছিল তারা বলল, ওদিক দিয়ে যান। হাঁটা শুরু করার পর পথ আর ফুরায় না। মা এবং মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে মেলায় প্রবেশ করেছি। মেলা কর্তৃপক্ষের এই অমানিব ব্যবস্থাপনা খুবই দুঃখজনক।’

এবারের বইমেলায় এমন অনেক অব্যবস্থাপনার গল্প হয়তো বলা যাবে। তারপরও উৎসবপ্রিয় মানুষ নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বইমেলায় আসছে, নিজেদের পছন্দ মতো বই কিনছে, বই পড়ছে, বই বহন করছে, বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে তুলছে।

কিন্তু মোটা-মোটা বই কিনলে, বই পড়লে, বইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরি করলেই তো আর মানসিকতার বিকাশ ঘটে না। এ জন্য আরও অনেক কিছুর পাঠ মানুষকে গ্রহণ করতে হয়— মার্জিত রুচির পাঠ, ভ্রাতৃত্বের পাঠ, সদাচারণের পাঠ, নম্রতার পাঠ, ভদ্রতার পাঠ!

বইমেলার সোহরাওয়ার্দী অংশে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে টিএসসি সংলগ্ন গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় চার ভদ্রলোকের দেখা মিলল। চার জনের হাতেই প্রচুর বই। বহ্যিক বেশ-ভূষাও সুন্দর। পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বইমেলা থেকে বের হচ্ছিলেন তারা।

সামনে গিয়ে বললাম, ‘আমাকে একটু সময় দেবন।’ ওই চারজনের ভেতর থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘দরকার নেই’। বললাম, ‘আমি সাংবাদিক’। ব্যক্তিটি আরও রুঢ় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে?’

একে তো বয়স্ক লোক, তার ওপর আবার গাদা গাদা বই হাতে। কিন্তু যে আচরণটা তারা করলেন, তা কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়ার মতো না। অতঃপর তারা হেঁটে চললেন সামনে দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পেছন থেকে গজাল দর্শন পর্বটার যবনিকাপাত সেরে নিলাম। কয়েকটা ছবিও তুলে রাখলাম।

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ: হাসান হাফিজুর রহমান’ এবং ‘স্মরণ: হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিনার মনসুর এবং কাবেদুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন শোয়াইব জিবরান, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, রুবেল আনছার এবং ওবায়েদ আকাশ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এ.এইচ.এম. লোকমান।

প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, হাসান হাফিজুর রহমান সকল বিচারেই এদেশের বিরল প্রতিভাবানদের একজন। সাহিত্যের প্রায় সবকটি মাধ্যমেই রয়েছে তার প্রতিভা ও শ্রমের উজ্জ্বল ছাপ। তবে তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। একই সঙ্গে একজন কর্মীও বটে। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন কবি ও কর্মীর দ্বৈত ভূমিকা। অপরদিকে হবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার এক উল্লেখযোগ্য নাম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষে বিভিন্ন সময়ে দেশে-বিদেশে প্রকৌশলীর কার্যনির্বাহ করলেও পরিশীলিত মেধার-মননে এবং আবেগমথিত হৃদয়বৃত্তির উৎসারণে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন কবি।

আলোচকরা বলেন, হাসান হাফিজুর রহমান তার কবিতার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কে বাঙ্ময় করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি একটি মুক্ত স্বাধীন-সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং নিজেও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংকলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অন্যদিকে, ষাটের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী চিত্রকল্প, উপমা ও কাব্যভাষায় নিজের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকলেও নিরীক্ষাপ্রবণ এই কবি স্বীয় হৃদয়-মননের মূল খোরাক তথা কাব্য রচনায় কখনো ক্ষান্ত দেননি।

সভাপতির বক্তব্যে এ. এইচ. এম. বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল দুই নক্ষত্রের নাম হাসান হাফিজুর রহমান এবং হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী। তারা তাদের জীবন, সৃষ্টিকর্ম ও আদর্শ দিয়ে আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রকিবুল হাসান, রাহাত মিনহাজ, ফেরদৌস নাহার এবং আশিক মুস্তাফা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন বদরুল হায়দার, টোকন ঠাকুর, খাতুনে জান্নাত, আহসান মালেক এবং কাজী আনিসুল হক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শিরিন জাহান, মীর মাসরুর জামান রনি এবং অনিমেষ কর। এছাড়াও ছিল শরণ বড়ুয়ার পরিচালনায় গীতিআলেখ্য ‘প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’, কবিরুল ইসলাম রতনের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যালোক’ এবং ইকবাল হাফিজের পরিচালনায় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘দনিয়া সবুজ কুঁড়ি কচি কাঁচার মেলা’-এর পরিবেশনা।

সংগীত পরিবেশন করেন ফারহানা ফেরদৌসী তানিয়া, রাজিয়া সুলতানা, মো. মেজবাহ রানা, আবুল কালাম আজাদ, নাফিসা ইসলাম ফাইজা, সুমন চন্দ্র দাস, সুজন হাওলাদার। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন রাজু চৌধুরী (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কি-বোর্ড), দীপঙ্কর রায় (অক্টোপ্যাড), মো. আতিকুল ইসলাম (বাঁশি)।

আগামীকাল ৩০ মাঘ, ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার অমর একুশে বইমেলার ১৩তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন মোনায়েক সরকার, হারিসুল হক এবং অপূর্ব শর্মা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আবেদ খান।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

গজাল দর্শন বইমেলা ২০২৩


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে হামলার হুমকি!
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৫

সম্পর্কিত খবর