নিপাহ ভাইরাস নিয়ে ‘তথ্য লুকোচুরিতে’ হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৬
ঢাকা: চলতি বছর দেশের ছয়টি জেলার ১০ জনের নমুনায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর মাঝে নবজাতকসহ মারা গেছে সাতজন। এ ছাড়া সার্ভিলেন্সের আওতায় কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নমুনাও পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে দাবি প্রতিষ্ঠানটির। তবে নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে যেখানে সেসব এলাকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে রোগী ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই বলে জানিয়েছে সিভিল সার্জন কর্মকর্তারা।
শুধু তাই না, স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কাছেও কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন করার কারণে নিপাহ ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানটির কাছেই থাকে। যার ফলাফল প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে আপডেট করা হয়ে থাকে।
তবে সেই আপডেট বিষয়েও জেলা সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা (ইউএইচএফপিও) অবগত নন বলে অভিযোগ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্ভিল্যান্স বা আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশনের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে না পৌঁছানোটা হচ্ছে সমন্বয়হীনতার ফল। যে সব জেলায় আক্রান্ত হয়েছে তাদের কাছে অন্তত তথ্য পৌঁছানো জরুরি। একইভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কাছে তথ্য না থাকাটাও দুর্ভাগ্যজনক। সংশ্লিষ্ট এলাকার পাশাপাশি দেশের মানুষকে সচেতন করার জন্যেও এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। একটা কেইসের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে শনাক্ত হওয়ার তথ্য পেতে পেতেই যদি রোগী মারা যায় তবে সেই সময়টাতে অন্য যারা আক্রান্ত হতে পারে তাদের ঝুঁকিতে ফেলার দায় কে নেবে?
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নিপাহ ভাইরাসে ১০ জন আক্রান্তের মাঝে সাতজনই যেখানে মারা গেছে সেখানে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে সেসব এলাকার অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়াও জরুরি। দেশে এখন সংক্রামক ব্যাধি আইন কার্যকর আছে। প্রয়োজনে এই আইনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে খেজুর গাছের মালিক ও গাছিদের সতর্ক করার পাশাপাশি আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া যেতে পারে।
চলতি শীত মৌসুমে সর্বোচ্চ চারজনের মাঝে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ পাওয়া যায় রাজবাড়ী জেলায়। এই জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় তিনজন আক্রান্তের মাঝে মারা গেছে দুইজন। গোদাবরী উপজেলার একজন মারা গেছে।
কতজন রোগী ও তাদের বয়সসীমা কত?— প্রশ্নের উত্তরে রাজবাড়ী জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইব্রাহিম টিটন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আইইডিসিআর আমাকে কোনো তথ্য দেয়নি। ওরা জাস্ট এখানে রিসার্চ করেছে। এরপরে সার্ভে করে চলে গেছে। আমাদের সঙ্গে কোনো তথ্য শেয়ার করেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন প্রিভেনশনের কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি যেন খেজুরের রস কেউ না খায়। কিন্তু কারা আক্রান্ত হয়েছে বা তাদের শারীরিক অবস্থা কী— এ সম্পর্কে আমাদের কাছে অফিসিয়ালি কোনো তথ্য নেই।’
চলতি শীত মৌসুমে দুইজনের নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ পাওয়া যায় নওগাঁ জেলায়। এর মাঝে একজন মারা গেলেও আরেকজন চিকিৎসাধীন আছেন। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানান নওগাঁ জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ রায়হানুজ্জামান সরকার।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ডিসেম্বরে নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণযুক্ত রোগী পাওয়া যায়। জানুয়ারিতে আইইডিসিআর থেকে লোকজন এসে নমুনা সংগ্রহ করে। তারা পজিটিভ হলে আমাদের জানায়। সেই হিসেবে আমাদের দুইজনের নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানায়। এর মাঝে একজন মারা গেছে। তবে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের রিপোর্ট পজিটিভ হলে জানায়, নেগেটিভ হলে জানায় না।’
পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে ছয় বছরের এক বাচ্চা মারা যায় নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে।
ছয় বছরের বাচ্চা একাই কী খেজুরের রস খেয়েছিল? তার পরিবারের অন্যান্যদের অবস্থা কী?— এমন প্রশ্নের উত্তরে সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে একজন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। তবে এগুলোর কন্টাক্ট ট্রেসিং বা অন্য কারো মাঝে সংক্রমণ পাওয়া গেছে কিনা তা নিয়ে কোনো তথ্য নেই। নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে আইইডিসিআর। সেখান থেকে ফলাফল জানানো হয়নি।’
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি’র ইউএইচএফপিও ডা. মো. নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার উপজেলায় যে কয়জনের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার তথ্য আপনাদের নিতে হবে আইইডিসিআর থেকে। আমাদের এভাবেই নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমরা খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।’
নমুনা সংগ্রহ, সংক্রমণ শনাক্তে দেরি
চলতি শীত মৌসুমে দেশে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী বিভাগের গোদাগাড়ী উপজেলায় এক নারী। ৩৫ বছর বয়সী এই নারীর মাঝে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পায় ২৯ ডিসেম্বর। ১ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩ জানুয়ারি তার সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায় নমুনা পরীক্ষায়। পরবর্তীতে ৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
১১ জানুয়ারি গণমাধ্যমে এ তথ্য জানান আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন।
নওগাঁ জেলা সদরের একজন আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পায় ৭ জানুয়ারি। ১১ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৩ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানা যায়। তবে আরেকজনের ক্ষেত্রে ৬ জানুয়ারি লক্ষণ প্রকাশ পেলেও সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই তিনি মারা যান।
রাজবাড়ী জেলার ছয় বছরের এক শিশুর মাঝে নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পায় ১৪ জানুয়ারি। সেদিনই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯ জানুয়ারি তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ২১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করে।
ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১৮ বছর বয়সীকে হাসপাতালে আনা হয় অজ্ঞান অবস্থায়। চিকিৎসকরা জানান, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কয়েকবার খিঁচুনির কথা। এ ছাড়াও সঙ্গে ছিল জ্বর আর প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট ও এক দিন আগ থেকে শুরু হওয়া পাতলা পায়খানা।
স্বজনরা জানান, রোগী বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ১ জানুয়ারি কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার পার্টি করে। এরপরে ধীরে ধীরে তার মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৮ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ১৯ জানুয়ারি সে মারা যায়।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
দেশে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন? কতজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে?— এমন প্রশ্নের স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এস এম গোলাম কায়সার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আজকে (৭ ফেব্রুয়ারি) আইইডিসিআরের কাছে লিখিতভাবে তথ্য চেয়েছি। আশা করছি আগামী দুইদিনের মধ্যে এই ফলাফল পাব।’
তবে রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি ডা. কায়সারের কাছ থেকে।
ইউএইচএফপিও, সিভিল সার্জন ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয়রা তথ্য জানে না। এমনটা কেন?— প্রশ্নের উত্তরে আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘কারণ আমরা ডিজিজ আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন করি। আর যখন যে তথ্য পাওয়া যায় তা আপডেট করা হয় ওয়েবসাইটে।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছর এখন পর্যন্ত কতজন আক্রান্ত হয়েছে নিপাহ ভাইরাসে সেটি এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলার সময় হয়নি। এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান চলছে। শেষ হলে রোগী ও মৃতের সংখ্যা জানা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। খেজুরের কাঁচা রস নিয়ে কোনো উৎসব করা বা উৎসবে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া ঠিক হবে না।’
দেশে প্রথম নিপাহ রোগী শনাক্ত হয় মেহেরপুর জেলায়, ২০০১ সাল। সেই থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোন জেলায় কত রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার তালিকা করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা।
৩০ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ থেকে রাজধানীর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া এক চিঠিতে ২৮টি জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়।
পরবর্তীতে ৩১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ থেকে সিভিল সার্জনদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ৩২ জেলা নিপাহ ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে আছে।
আক্রান্ত ৩৩ জেলা
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের মোট ৩৩টি জেলায় নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকা অনুযায়ী শনাক্ত হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে আছে বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, ঢাকা, দিনাজপুর, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, খুলনা, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, মাদারীপুর, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, নীলফামারী, নড়াইল, পাবনা, পঞ্চগড়, রাজবাড়ী, রাজশাহী, রংপুর, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল ও ঠাকুরগাঁও।
তালিকা অনুযায়ী সিলেট বিভাগের কোনো এলাকায় নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়নি।
‘সমন্বয়হীনতায় ঝুঁকির মুখে জনস্বাস্থ্য’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ২০২৩ সালে এসেও আমরা নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাতজনের মৃত্যুর সংবাদও পেয়েছি। বাস্তবতা হলো, আমরা যে কয়টা কেইস বা সংক্রমণের তথ্য পাচ্ছি তার চাইতেও বেশি আক্রান্ত থাকাটা স্বাভাবিক। হয়তবা দেখা গেল কয়েকগুণ বেশি। কেননা সবাই তো আর নমুনা দিতে এগিয়ে আসবে না আবার সবার নমুনা নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই রোগী মারা যাচ্ছে। আবার দেখা যায় মৃত্যুর পরে জানানো হচ্ছে কারো সংক্রমিত হওয়ার বিষয়ে। অর্থাৎ বিষয়টা অনেকটা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে ডাক্তার আসার পূর্বেই রোগী মারা গেল। মানে এতদিনে আমি পরীক্ষা করব, তারপরে আমি এটির ওপর একটি মেসেজ তৈরি করব। এর মধ্যে যারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে তারা আক্রান্ত হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাঁদুড় যতদিন থাকবে ততদিন এই নিপাহ ভাইরাস থাকতে পারে। তারা একটি হেলদি ক্যারিয়ার যে কারণে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। এইক্ষেত্রে কোনো জায়গায় লক্ষণ দেখা যাওয়ার পরে সেখানে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানানোর জন্য আইইডিসিআর যে সময় নিচ্ছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ।’
ডা. বেনজীর বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিডিসি, আইইডিসিআরসহ অন্যান্য বিভাগের সমন্বিত পদক্ষেপ খুবই জরুরি। দেখা গেল সিডিসি ও আইইডিসিআর— এই দুই বিভাগের বিল্ডিংয়ের দূরত্ব ৫০ মিটারও না কিন্তু তাও তথ্যের বিষয়ে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের একে অপরকে সহযোগিতা না করার বিষয়টি পরিষ্কার। নইলে সিডিসি’র একটা শাখার ডিপিএম তো আর মেইল দিয়ে তথ্য চাইতো না আইইডিসিআরের কাছে।’
তিনি বলেন, ‘খেজুরের রসের মৌসুম তো আর বেশি বড় না। ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগেই শেষ বলা যায়। হয়তবা মার্চ পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে কিছু ক্ষেত্রে-এর বেশি তো আর না? আবার খেজুরের রস যে সারা দেশে পাওয়া যায় বা আছে তেমনও কিন্তু না। এক্ষেত্রে এটি অনেক সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে নানা জায়গায়। কিছু কিছু এলাকায় গাছি না থাকার কারণে কাটে না রসের জন্য। যেসব এলাকায় খেজুরের গাছ তুলনামূলক বেশি সেসব স্থানে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সার্ভিল্যান্স করে যে এলাকায় বাদুরের মাধ্যমে খেজুরের রসে সংক্রমণ ছড়ানোর তথ্য পাওয়া যায় সেসব স্থানে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংক্রামক রোগগুলোর মাঝে যদি গ্রেডিং করা হয় তবে দেখা যাবে নিপাহ ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়ায়। ২০০১ সালের পর থেকে আমাদের দেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। যদিও বেশি না কিন্তু তাও পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে আমরা এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। অন্য দেশেও কিন্তু তেমন পাওয়া যায় না। আর তাই নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নিয়ে খুব বেশি এগোয়নি কেউই।’
ডা. বেনজীর বলেন, ‘যদি আমরা নিপাহ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করি তবে বাস্তবভিত্তিক ও উদ্ভাবনীমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা খেজুরের গাছ মালিক ও গাছি আছে তাদের একটি লিস্ট তৈরি করা যেতে পারে। এরপরে তাদের খেজুরের কাঁচা রস বিক্রি না করার অনুরোধ করা। তাদের সম্পৃক্ত করা না গেলে মানুষকে সচেতন করার কাজটি দুরূহ। কারণ পত্রিকা বা অন্যান্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সচেতন করা কতটুকু সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি গাছ মালিক ও গাছিদের সতর্ক করার পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিওকর্মীদের সাহায্য নেই তবে ভালোভাবে প্রচারণার কাজটা করা যায়। বিশেষ করে দেশে যেহেতু সংক্রামক ব্যাধি আইন চালু আছে— সেই আইনের মাধ্যমেও সতর্ক করতে পারি সবাইকে। বিশেষ করে সেসব এলাকায় যেখানে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার পরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ সোজা ভাষায় খেজুরের কাঁচা রস যে বা যারাই বিক্রি করতে তাদের আইনের আওতায় আনার বিষয়েও সতর্ক করা যেতে পারে। একইসঙ্গে সেসব এলাকায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ অন্যান্যদের মাঝে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। যেনো তারাই এলাকার নাগরিকদের সচেতন করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে প্রাথমিকভাবে।’
মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ
গত ২২ বছরে দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩৩৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২৩৭ জন, অর্থাৎ মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ। এ বছর এ পর্যন্ত ছয় জেলায় ১০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৭ জন। এ ছাড়া সন্দেহজনক আরও বেশ কিছু ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। শিগগিরই এর ফলাফল জানা যাবে।
আইইডিসিআর জানিয়েছে, এ বছর এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ জনকে তারা শনাক্ত করতে পেরেছে। এসব রোগী শনাক্ত হয়েছে শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর—এই ছয় জেলায়। আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে ৬ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী। তাদের মধ্যে মারা গেছেন চারজন পুরুষ ও তিনজন নারী। অর্থাৎ মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।
সারাবাংলা/এসবি/একে