বঙ্গবন্ধু থেকে সাহাবুদ্দিন— রাজনীতিক ১০ জন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩০
ঢাকা: বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হলেন মো. সাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত এই প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন। ক্ষমতাসীন এই দলটির উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সাহাবুদ্দিন-ই কিশোরগঞ্জের প্রবীণ রাজনীতিক মো. আবদুল হামিদের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন। শপথ গ্রহণের পর তিনি বঙ্গভবনের বাসিন্দা হবেন। দুঃসময়ে রাজপথে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্ব দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য মো. সাহাবুদ্দিন দেশের সর্বোচ্চ এই পদটিতে বসতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৭ জন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে ১০ জন রাজনীতিক। বাকিরা বিচারপতি, সেনাশাসক ও শিক্ষক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রথম মেয়াদে ছিলেন। এরপর চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত ছিলেন। দ্বিতীয় (অস্থায়ী) রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ছিলেন। তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ দায়িত্বে ছিলেন। পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদউল্লাহ ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত ছিলেন। ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ দায়িত্ব পালন করেন।
অষ্টম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ থেকে ৩০ মে ১৯৮১ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। নবম (অস্থায়ী) ও দশম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার ৩০ মে ১৯৮১ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি আহ্সান উদ্দীন চৌধুরী ২৭ মার্চ ১৯৮২ থেকে ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন। ত্রয়োদশ (অস্থায়ী ও চতুর্দশ) রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ৯ অক্টোবর ১৯৯১ এবং ৯ অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে ১৪ নভেম্বর ২০০১ দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুর রহমান বিশ্বাস ৯ অক্টোবর ১৯৯১ থেকে ৯ অক্টোবর ১৯৯৬ দায়িত্ব পালন করেন। ষোড়শ রাষ্ট্রপতি হিসেবে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৪ নভেম্বর ২০০১ থেকে ২১ জুন ২০০২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। সপ্তদশ (ভারপ্রাপ্ত) রাষ্ট্রপতি জমির উদ্দিন সরকার ২১ জুন ২০০২ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন। অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ঊনবিংশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. জিল্লুর রহমান ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে ২০ মার্চ ২০১৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। বিংশতম-একবিংশতম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০ মার্চ ২০১৩ থেকে ২৩ এপ্রিল ২০২৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন।
সোমবার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে দু’টি মনোনয়নপত্র পেয়েছি, দু’টিই আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। তার মধ্যে একটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কর্তা হিসেবে গ্রহণ করেছি। আরেকটি মনোনয়পত্র গ্রহণের কোনো আবশ্যকতা এ-কারণে ছিল না।’
প্রজ্ঞাপন তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের তারিখ অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র পরীক্ষার পর মাত্র একজনের মনোনয়নপত্র বৈধ থাকায় রাষ্ট্রপিত নির্বাচন আইন-১৯৯১ (১৯৯১সনের ২৭নং আইন) এর ধারা ৭ অনুসারে জনাব মো. সাহাবুদ্দিন, পিতা: মরহুম শরফুদ্দিন আনসারী, বাসা/হোল্ডিং-৮৮/১, গ্রাম/রাস্তা: শিবরামপুর, পাবনা পৌরসভা, ডাকঘর-পাবনা, পোস্ট কোর্ড-৬৬০০, উপজেলা পাবনা সদর, জেলা-পাবনা; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলেন।’
দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ দেশের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেশিরভাগ সময়েই দায়িত্ব পালন করেছেন সেনাপ্রধান, বিচারপতি, শিক্ষক, সেনাশাসকসহ অনেকেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মাত্র কয়েকজন রাজনীতিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য হয়ে ছাত্র রাজনীতির পথপরিক্রমায় যুবলীগ নেতা হিসেবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ পরে বিচারক ও দুদকের কমিশনার হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির উচ্চপদে আসীন হন মো. সাহাবুদ্দিন। সেই দুঃসময়ের সাহসী বিশ্বস্ত রাজনৈতিক যোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন হলেন বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি।
এ পর্যন্ত ১৭ জন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারপ্রাপ্ত, অস্থায়ী ও পূর্ণ মেয়াদসহ ১৭ জনের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১০জন রাজনীতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়েই গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। তার প্রথম মেয়াদ ধরা হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় অস্থায়ী সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদউল্লাহ এক সময় আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হন তিনি। ছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং ১৯৯১ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ছিলেন খন্দকার মোশতাক। আওয়ামী লীগ করলেও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত এ নেতার কুখ্যাতি রয়েছে। তার দায়িত্বকাল ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস মুসলিম লীগ তথা বরিশাল বিভাগের শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির শাসন আমলে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ষোড়শ রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পেশাজীবী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। তার পদত্যাগের পর সপ্তদশ (ভারপ্রাপ্ত) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া জমিরউদ্দিন সরকার ন্যাপ-ভাসানীর রাজনীতি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এছাড়া মো. জিল্লুর রহমান, মো. আবদুল হামিদ ও মো. সাহাবুদ্দিন- এদের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রপতি হন।
সপ্তম রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, নবম ও দশম রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, একাদশ রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দীন চৌধুরী, ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
তবে অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ পেশায় শিক্ষক। অষ্টম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুজনেই সেনাশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি পদ দখল করে পরে ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম