Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেলের ৩ বছরের প্রকল্প ঠেকেছে ১৩ বছরে, ব্যয় বেড়েছে চার গুণ

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১০

ঢাকা: হয়নি সমীক্ষা, করা হয়নি নকশা, পরিকল্পনা ছিলো দুর্বল, ছিলো না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়— এমন এক অন্ধগলি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’। যে কারণে তিন বছর মেয়াদের প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে ১৩ বছরে, কাজ এগিয়েছে অর্ধেক, ব্যয় বেড়েছে চারগুণ।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এ প্রকল্প শেষ করতে আরও তিন বছর লেগে যেতে পারে। ফলে এই প্রকল্প এখন রেলওয়ের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশ উদ্বোধন করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে-আসতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ঢাকা-টঙ্গী, টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশন। অথচ এই দুই সেকশনে দু’টি ডুয়েল গেজ লাইন ও একটি ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন রয়েছে। যে কারণে এই পথে চাহিদা থাকার পরও বেশিসংখ্যক ট্রেন পরিচালনা করা যায় না। তাই ঢাকা থেকে আরও বেশি ট্রেন পরিচালনা করার পাশাপাশি ভ্রমণের সময় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে।

লক্ষ্য ছিলো এ প্রকল্পের আওতায় অপারেশনাল ক্যাপাসিটি বাড়াতে প্রকল্পের আওতায় সিগন্যালিং ও টেলিকম কাজসহ ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে দ্বিতীয় ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ৩৩.৪৮ কিলোমিটার লুপলাইনসহ ১১৬ কিলোমিটার ও চারটি স্টেশন পুনর্নির্মাণ করা। আর এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ ২০১৫ সালে শেষ করার কথা থাকলেও ওই বছরে নিয়োগ দেওয়া হয় পরামর্শক। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা বাড়ানো হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ নানা প্রক্রিয়া শেষ করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে।

বিজ্ঞাপন

এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। আর ৮৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় গিয়ে ঠেকে ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকায়।

গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এর কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। এরপর চলে আসে মহামারি কোভিড-১৯। যে কারণে ভারত থেকে ইউটিলিটি শিফটিং বন্ধ হয়ে যায়। কম লোকবল নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকলেও তা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত সাড়ে এগারো বছরে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার রেলপথের ডাবল লাইনের কাজ সিগন্যাল ছাড়া মোটামুটি শেষ। টঙ্গী থেকে বনানীর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে কাজ চলমান। বনানী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি শূণ্য। এই ১২ কিলোমিটার পথের কাজ শুরুই করতে পারেনি রেলওয়ে। এই অংশের পুরো বারো কিলোমিটার পথ জুড়েই চলছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। ফলে এই অংশের ভূমি বুঝে পায়নি রেলওয়ে।

জানা যায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে। এরপর শুরু হবে রেলওয়ের কাজ।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১২ সালের নভেম্বরে নেওয়া হয় ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কথা ছিলো ২০১৫ সালে শেষ করার। এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটে চলমান প্রকল্পটির অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। আর ৮৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকায়। এই পরিস্থিতিতে আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৭ সাল আর খরচ আরও ২ হাজার ১৫৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়ানোর চিন্তা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের ব্যয় ও সময় যদি অনুমোদিত হয় তাহলে কাজ শেষ করতে আরও ৪ বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল লেগে যাবে। খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৩ হাজার ২৬৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। যা প্রথম নির্ধারণ করা ব্যায়ের চারগুণ।

সাধারণত কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই থাকে প্রথম ধাপে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে এই প্রকল্প শুরু করেছে সমীক্ষা ছাড়াই। শুধু সমীক্ষাই নয়, এখানে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে করা হয়নি সমন্বয়, এমনকি কোন প্রক্রিয়ায় এই লাইন নির্মাণ হবে তার কোনো নকশাও করা হয়নি। যে কারণে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পরে ‘ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্প। ২০১২ সালে নেওয়া প্রকল্প ২০২৩ সালেও শেষ করা যাচ্ছে না।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সমীক্ষা, দরপত্র প্রক্রিয়া, পরামর্শক নিয়োগ, অর্থ সংগ্রহ, জমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি শিফটিং ও করোনাভাইরাসসহ নানা কারষে প্রকল্প বাস্তবায়নে এতো বিলম্ব। প্রকল্পের বাস্তবায়নে প্রধান বাধা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

তারা জানান, কমলাপুর থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ হচ্ছে রেললাইনের ওপরে। নতুন রেলপথের কাজের এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্রেন ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি চলাচল করে। এ কারণে প্রায় ৮ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এই প্রকল্পটি নেওয়ার তিন বছর আগে নেওয়া হয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।
প্রকল্প কর্মকর্তারাই বলছেন, আগে সমীক্ষা হলে এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এই প্রকল্প নিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে এই প্রকল্পের বনানী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে রেলওয়েকে।

সমীক্ষা, নকশা আর সমন্বয় ছাড়া শুরু করা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন প্রকল্প পরিচালকও। প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পে কোনো সার্ভে করা হয়নি। তার আগে প্রকল্প অনুমোদন, পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া তাতে চলে গেছে এক থেকে দেড় বছর। যে কারণে ২০১২ সালের প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ডিটেইল ডিজাইন, দরপত্র আহ্বান আর ঠিকাদার নিয়োগ দিতে দিতেই মেয়াদ শেষের দিকে চলে আসে। তার ওপরে কোভিড-১৯। আর অন্যদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটা বাধা তো রয়েছেই। এটা না থাকলে কাজ আরও এগিয়ে যেতো।’

এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল লাইনের কাজ সিগন্যাল ছাড়া মোটামুটি শেষ। বনানী থেকে কমলাপুর অংশের কাজ শুরু করা না গেলেও বাকি অংশের কাজ চলমান।’

তবে আগামী জুনের মধ্যে শেষ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেজন্য মেয়াদ অর্থ দুটোই বাড়াতে হবে। যে ১১ কিলোমিটার আমরা উদ্বোধন করা হয়েছে, সে লাইন দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করবে। প্রকল্পের বাকি অংশের কাজও চলবে। যা দেরি হয়েছে হয়ে গেছে এখন শেষ করাই মঙ্গল।’

উল্লেখ্য, টঙ্গী-জযদেবপুরের ১১.০৯ কিলোমিটার রেলপথ রাজধানীর সঙ্গে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইনটি প্রতিদিন ৪৪টি ট্রেন চলাচলের জন্য উপযুক্ত হলেও এই লাইন দিয়ে প্রতিদিন ৫৮টি ট্রেন চলাচল করে।

সারাবাংলা/জেআর/এমও

ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেল

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর