Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফাগুন দিনের ভালোবাসায় রাঙানো বইমেলা

আসাদ জামান
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৪২

অমর একুশে বইমেলার ১৪তম দিন। ফাল্গুনের প্রথম দিনের সূর্য বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট গেটের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি। বের হওয়ার গেটেও ঘরে ফেরা মানুষের জটলা।

এদের অধিকাংশ পরনে লাল-সাদা-হলুদেমিশেল শাড়ি, মাথায় গোলাপ-জিপসি-গাঁদা ফুলের রিং, কানের দুল, নাকের ফুল, কাঁচের চুড়ি, গলার হার এবং পায়জামান-পাঞ্জাবির রং জানান দিচ্ছে— ‘বাতাসে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে/ মধুর অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই/মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে/ থাক তব ভুবনের ধূলি মাখা চরণে/মাথা নত করে রব…/ বসন্ত এসে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

বসন্ত একা আসেনি, সঙ্গে ভালোবাসা দিবসও এসেছে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব সভ্যতা সংস্কৃতিতে বহুল চর্চিত ও উদযাপিত ভ্যালেন্টাইন ডে’ও এসেছে আজ। প্রেম ও ভালোবাসা বিনিময়ের বাণিজ্যিক দিবসে পরিণত হওয়া ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে’ বারতি উত্তাপ যোগ করে অমর একুশে বইমেলায়।

বিস্তৃত পরিসরের বইমেলার প্রতি ইঞ্চি জায়গা তরুণ-তরুণী, কপোত-কপোতীর পদধূলিতে মুখর। বায়সের সীমারেখায় নিজেদের বেঁধে না রেখে পঞ্চাশ-ষাটোর্ধ্ব যুগল-দম্পতিরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি অথবা লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি এবং হলুদ-সাদা-লাল পাঞ্জাবি পরে মেলায় এসেছেন। তাদের পদচারণায় বাঙময় হয়ে উঠেছিল ফাল্গুন ও ভালোবাসায় রাঙানো অমর একুশে বইমেলা।

সোহরওয়ার্দী উদ্যানের জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী অনিতা বাড়ইকে নিয়ে ছবিতে পোজ দিচ্ছিল দিলীপ বিশ্বাস। আজিমপুর থেকে মেলায় আসা ষাটোর্ধ্ব দিলীপ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভালোবাসার জন্য আলাদা কোনো বয়স লাগে না। সব বয়সেই ভালোবাসা যায়, প্রেমে পড়া যায়। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, সেটা যেন প্রচলিত সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। কে কোন বয়সে কার প্রেমে পড়বে, সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রুচির ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

‘হাতের কাছে হওয়ায় মাঝে মধ্যেই বইমেলায় আসি। আজকে যেহেতু পহেলা ফাল্গুন এবং বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তাই এমন সুন্দর দিনটাকে মিস করতে চাইনি। স্ত্রীকে নিয়ে বইমেলায় চলে আসছি’— বলেন দিলীপ বিশ্বাস।

জলাধারের পাশেই বন্ধুর সঙ্গে ছবি তুলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী সুরভী আক্তার। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বইমেলা তো ধরতে গেলে আমার বাড়ির উঠান। খুব বেশি ব্যস্ততা না থাকলে প্রায় প্রতিদিনই বইমেলায় আসি। আর আজ বিশেষ দিন।’

সুরভীর বন্ধু মুনিবুর রহমান শিমুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে জব করায় খুব একটা আসা হয় না বইমেলায়। কিন্তু আজকের দিনটা যেহেতু স্পেশাল, সেহেতু মিস করার কোনো উপায় ছিল না। ও (সুরভী) আগেই বলে রেখেছিল, আজকের দিনটা ঢাকায় থাকতে। তাই গতকালই যশোর থেকে ঢাকায় চলে আসছি। রাতে আবার ফিরতে হবে।’

‘ফাল্গুন’ আর ‘ভালোবাসায়’ অমর একুশে বইমেলা রঙিন হয়ে উঠলেও বই বিক্রি খুব একটা বাড়েনি। অন্য সাধারণ দিনের মতোই ছিল স্টল-প্যাভিলিয়নের অবস্থা। বিক্রয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছুটির দিনে ভীড় বাড়ার পাশাপাশি বিক্রিও বাড়ে। কিন্তু বিশেষ দিবসে ভীড় বাড়লেও বিক্রি বাড়ে না।

সন্ধ্যা ছয়টায় ‘আদী প্রাকশন’-এর স্টলে কথা হয় বিক্রয়কর্মী এসকে সুজন আহমেদ ইমরানের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আজকের ভীড়টা শুক্র-শনিবারের মতোই। কিন্তু বিক্রি বেশি না। যারা বইমেলায় এসেছেন, তারা অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। এই শ্রেণিটা খুব বেশি বই কেনে না। যারা বই কেনে তারা এরকম ভীড়ের মধ্যে আসে না। তবে এবারের বইমেলায় বই বিক্রি গতবারের চেয়ে ভালো। আমাদের ‘দ্য প্রফেট’ বইটা খুব ভালো চলছে। অন্যান্য বইও ভালো বিক্রি হচ্ছে।’

বইমেলায় মেলা তো শুধু বই বিক্রি আর বই কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গের এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। স্টুডেন্ট ওয়েজ এবং কথা প্রকাশের প্যাভিলিয়নটা পেছনে নাম না জানা এক কণ্ঠশিল্পী গলা ছেড়ে গেয়ে যাচ্ছেন— ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে/গান গাইতে পারি নি বলে/নাইরে আমার দুঃখের কোন শেষ/মনের বেতার কেন্দ্রে তবু/গান গেয়ে যাই দিনে রাতে/আমার মাটি সোনার বাংলাদেশ/ওরে মানুষ গাও সকলে বাংলাদেশের গান/ আল্লাহ তুমি থাইকো সহায় রাইখো দেশের মান।’

অখ্যাত এই শিল্পীর গান শোনার জন্য মুহূর্তের মধ্যে কয়েক শ’ লোক জড়ো হয়ে গেল। কয়েকটি বেসরারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং মেলাব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইউটিউবাররা মুহূর্তের মধ্যে তাকে ঘিরে ধরল। ছেলেটিও দ্বিগুণ উৎসাহে গলা ছেড়ে গাইতে লাগলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে/গান গাইতে পারি নি বলে/ নাইরে আমার দুঃখের কোন শেষ..।’

মেলার লেখক বলছি মঞ্চ। সেখানেও হঠাৎ জটলা বেঁধে গেল। ঘটনা তেমন কিছু না। এখানেও সেই গান। নিজের বই নিয়ে কথা বলার শেষ মুহূর্তে কবি হাসান মাহমুদ গেয়ে উঠলেন, ‘হায়রে বৃষ্টি যখন মেঘের রঙ ধরে/ এই মন ছুটে যায় গাঙ্গের ওপারে/ ও গাঙ্গ একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে/ জানে না কারণ/ জল থৈ থৈ করে আমার মন/ আমার দেহ নাচে ব্যাঙের ধাচে/ পেলে বরিষণ/ জল থৈ থৈ করে আমার মন।’

মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ এবং বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জি এইচ হাবীব এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সম্পদ বড়ুয়া, রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মো. আবু জাফর এবং মাহবুবা রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফকরুল আলম।

প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, বহুকাল ধরেই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, হিস্পানিক, গ্রিক ও লাতিন সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে আসছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ এবং বাংলা নানান রচনা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে সাহিত্য অনুবাদকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। যদিও বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ বিপুল পাঠকের চাহিদাকে পূরণ করে চলেছে। আড়ালে থেকেই অনুবাদ সাহিত্য জাতীয় সাহিত্যের পুষ্টিলাভে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে।

আলোচকরা বলেন, আমাদের দেশে-বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ যত হয়েছে সে তুলনায় বাংলা সাহিত্যের বিদেশি ভাষার অনুবাদ কম হয়েছে। তথাপি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হলে সেখানে অনুবাদ-সাহিত্যও বিশেষ স্থান পাওয়ার দাবি রাখে। দেশি অনুবাদকের পাশাপাশি বিদেশি অনুবাদকদেরও বাংলা ভাষার সাহিত্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ফকরুল আলম বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দক্ষ অনুবাদক তৈরি করার জন্য আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি অনূদিত গ্রন্থ বিদেশি পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন হাসান মাহমুদ, আফতাব হোসেন, মিনার মনসুর এবং আইরীন নিয়াজী মান্না।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন ঝর্না রহমান, হাসান হাফিজ, হাসনাত লোকমান, মোশাররফ শরীফ, মাসুদ পথিক এবং শারমীন জাহান মিতু। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আওরঙ্গজেব আরু, শিমুল পারভীন এবং পারভেজ চৌধুরী। এছাড়া ছিল সৈয়দ শরিফুল আলম শফু- এর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাতৃভূমি’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন খুরশিদ আলম, মুর্শিদুদ্দীন আহম্মদ, নবীন কিশোর, সঞ্জয় কুমার দাস, আঞ্জুমান আরা শিমুল, চম্পা বণিক। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন নন্দ দুলাল বড়ুয়া (তবলা), সুমন রেজা খান (কি-বোর্ড), অমিত দাস (গিটার) এবং মনির হোসেন (অক্টোপ্যাড)।

আগামীকাল ২রা ফাল্গুন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি বুধবার অমর একুশে বইমেলার ১৫তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শহীদ ইকবাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হাফিজ রশিদ খান, অনিকেত শামীম এবং সরকার আশরাফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সাজ্জাদ আরেফিন।

সারাবাংলা/এজেড/একে

অমর একুশে বইমেলা ফাগুন দিন বইমেলা ২০২৩ বাংলা একাডমি ভালোবাসা দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর