শিশু ক্যানসার চিকিৎসা: রাজধানীতে ভোগান্তি, ঢাকার বাইরে আরও ভয়াবহ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:১৭
ঢাকা: প্রতি বছর দেশে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার শিশুর শরীরে ক্যানসার শনাক্ত হলেও চিকিৎসা সুবিধা সে তুলনায় বাড়েনি। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশু ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে চাপ বাড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তবে সরকারিভাবে হাতেগোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে শিশু ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলেও তার সবই ঢাকায়। এর ফলে রাজধানীর যেসব হাসপাতালে শিশু ক্যানসার রোগীদের সেবা দেওয়া হয়ে থাকে সেখানে শয্যাসংকটে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেও ফলাফল পাওয়া ক্ষেত্রে রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। তবে ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে শিশু ক্যানসার চিকিৎসা চিত্র ভয়াবহ।
দেশের ৩৩টি মেডিকেল কলেজের মাঝে দেখা যায় আটটি শিশু ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আলাদা বিভাগ আছে। তবে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ বাদে অন্যগুলোতে বিশেষায়িত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুনভাবে পাঁচটি মেডিকেল কলেজে শিশু ক্যানসার বিভাগ স্থাপন করার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি কোনো শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ থাকলেও দেখা যায় তারা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে রোগীদের পাঠিয়ে দেন ঢাকাতেই। দেশে জেলার সংখ্যা ৬৪টি হলেও শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আছেন ৫০ জনের মতো।
শুধু তাই না, দেশে প্রতিবছর শিশু ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেবা দেওয়ার জন্য সেই অনুপাতে বাড়েনি শয্যাসংখ্যা। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটসহ রাজধানীর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে শিশু ক্যানসার আক্রান্তদের জন্য শয্যা আছে ১৪৬টি। এর মাঝে সর্বোচ্চ ৪০টি বেড রয়েছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। আর তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় দরকার তিনটি সুবিধা— কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও অস্ত্রোপচার। খোদ রাজধানীতেই শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ছাড়া এসব সুবিধা আর কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই।
সারাদেশে যদি রোগীদের জন্য অন্তত মেডিকেল কলেজগুলোতে শিশু ক্যানসার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না যায় তবে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। প্রতি বিভাগীয় এবং জেলা শহরে শিশু ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে অনেক শিশু সঠিক চিকিৎসা পাবে এবং মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে।
কর্তৃপক্ষ বলছেন, শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসা হয় মূলত কোনো হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে। হেমাটোলজির আওতায় পড়ে রক্তের ক্যানসার আর অনকোলজি বলতে বোঝায় হাড়, পেশি, লিভার, কিডনি, ব্রেন ক্যানসার ইত্যাদি।
বিভাগীয় পর্যায়ে এসব বিষয় আমলে নিয়ে হাসপাতাল প্রস্তুতকরণের কাজ চলমান। সেগুলোর ভবন তৈরি হতে সময় লাগবে। তবে এরপরে চিকিৎসা পাবে শিশুরা।
ঢাকার বাইরে শিশু ক্যানসার শনাক্তে দীর্ঘসূত্রিতা
রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগীদের চাপ বেশি দেখা যায়।
সরেজমিনে বিএসএমএমইউ’র পেডিয়েট্রিক হেমাটোলোজি অনকোলজি বিভাগে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির ৩০টি বেডেই ভর্তি আছে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। বেড না পেয়ে মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। সেখানে থাকা আড়াই বছর বয়সী ঝুমুরের (ছদ্মনাম) মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত ছিল। ফার্মেসি থেকে জ্বরের ওষুধ খাওয়ানো হলেও জ্বর সেরে উঠে। তবে আবারও জ্বর আসতে থাকে থেমে থেমে। পরবর্তীতে দেখা যায় তার গলার নিচের অংশ ফুলে গেছে। এরপরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও করানো হয় নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে আবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এরপরে ঝুমুরের ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে জানা যায়।
শুধুমাত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরুর আগেই অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে বলেও জানান ঝুমুরের মা।
ঠিক তার পাশের শয্যাতেই ৭ বছর বয়সী আরেক শিশু চিকিৎসাধীন। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থেকে আসা এই শিশুর মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জ্বর আসার পরে দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে দেখা যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয় স্থানীয়ভাবে। তবে সেখানে কিছু শনাক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও পরে বিএসএমএমইউ’তে নিয়ে আসা হয় শিশুটিকে। মূলত বিএসএমএমইউ’তে আসার পরেই রোগ শনাক্ত হলেও চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এর আগে, সম্প্রতি সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও দেখা যায়, শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিভাগের ‘ডে কেয়ারেও’ রোগীরা দিনে এসে চিকিৎসা নিয়ে যায়।
এখানেই কথা হয় আহনাফ নামে এক শিশুর মায়ের সঙ্গে। যশোরের নলডাঙ্গার পাঁচ বছরের আহনাফের জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে পেট ফুলে যায়। স্থানীয় এক ফার্মেসির কর্মচারীর পরামর্শে সন্তানকে একটানা চারদিন নাপা সিরাপ খাওয়ান তার অভিভাবকরা। কিন্তু জ্বর না কমার কারণে স্থানীয় ফার্মেসির একই ব্যক্তির পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা হয়। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় প্রথম যশোর মেডিকেল কলেজ ও এরপরে খুলনা মেডিকেল কলেজে যায় চিকিৎসার জন্য। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেও কোনো রোগ শনাক্ত হয়নি। পরে ঢাকার আসার পরে বেসরকারিতে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেও শনাক্ত হয়নি কোনো রোগ।
পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে টিকেট কেটে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরে আবারও নতুনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এই সময় আহনাফের লিভারে টিউমার শনাক্ত হয়। তবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় লেগে যায় ২৯ দিন যা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে আহনাফকে।
ঢাকায় শিশু ক্যানসারে আক্রান্তদের শয্যাসংখ্যা
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের শিশু ক্যানসার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দু’টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু ক্যানসার রোগের বিভাগ আছে ও চিকিৎসা হচ্ছে। এর মাঝে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ১৫টি শয্যা রয়েছে।
এছাড়া বিএসএমএমইউতে ৩১টি ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৩০টি শয্যা রয়েছে শিশু ক্যানসারে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।
জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শাহ মোহাম্মদ রাশেদ জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘এখানে বাচ্চাদের জন্য ৪০টি বিছানা আছে। সারা দেশের রোগী বিবেচনায় এটা খুবই কম। শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসায় মূলত কেমোথেরাপি নিতে হয়। সরকারি হাসপাতালে ৯০ শতাংশ ওষুধ সরবরাহ আছে। কেমোথেরাপির ব্যবস্থা আছে। তবে এই ওষুধ খুবই ব্যয়বহুল। তাই বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা কঠিন। সে জন্য আমাদের হাসপাতালে চাপ বেশি।’
এছাড়া রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন বিভাগ খোলা হলেও এখনও কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
দেশের অন্য ৩০টি মেডিকেল কলেজে শিশু ক্যানসার চিকিৎসা পরিস্থিতি
ঢাকার বাইরে দেশের পুরাতন ৬টি মেডিকেল কলেজে শিশু ক্যানসার বিভাগ থাকলেও নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সামর্থ্য অনুযায়ী। তবে অন্য মেডিকেল কলেজগুলো অভাব রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ক্যানসার ও রক্তরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জোহরা জামিলা খান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালসহ আরও কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে শিশু ক্যানসার চিকিৎসা হয়। তবে জনবলের সংকট আছে. যা দূর করার জন্য কর্তৃপক্ষ কাজ করছেন।’
ঢাকার বাইরে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটও
জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শাহ মোহাম্মদ রাশেদ জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু ক্যানসার ইউনিটে একজন সিনিয়র অধ্যাপক আছেন। তবে সেখানে জুনিয়র পর্যায়ে কেউ নাই। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজনকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে পাস করার পরে। সেখানে আবার সিনিয়র হিসেবে কেউ নাই। অর্থাৎ সেখানে কনসালটেন্ট বা অধ্যাপক মর্যাদার কেউ নেই।’
অন্য মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২০ সাল থেকে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন বনি ইয়ামিন। তবে হাসপাতালটিতে সংকটাপন্ন রোগী এখানে রাখা হয় না বলে জানা গেছে।
রংপুর ও সিলেটে বিভাগীয় হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসকই নেই বলে জানিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক।
বাকি বিভাগীয় হাসপাতালগুলোর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ আছে শুধু কাগজে-কলমে। এর মধ্যে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন শিশু ক্যানসার চিকিৎসক আছেন। তবে তিনি শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে নয়, অন্য বিভাগে কাজ করছেন।
রংপুর ও সিলেটে বিভাগীয় হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসকই নেই।
রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে চিকিৎসকদের নিয়োগ জরুরি
অধ্যাপক ডা. শাহ মোহাম্মদ রাশেদ জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘যেসব মেডিকেল কলেজের নাম বলেছি সেগুলোতে ডিপার্টমেন্ট চালু করা হলেও এখানে কোনো পোস্টিং দেওয়া হয়নি। সেগুলো এখনো প্রসেসিংয়ে আছে। হয়তো আগামী দুই থেকে চার মাসের মাঝে পোস্টিংগুলো হয়ে গেলে সমস্যা সমাধান হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই নিয়োগগুলো হয়ে গেলে ঢাকার বাইরেও শিশুরা ক্যানসার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিতে পারবে। কারণ অনেক চিকিৎসক পাস করে বসে আছে। তাদের যদি অন্তত সহকারি অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে শিশু ক্যানসার বিভাগ চালু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে একজন সিনিয়রের সঙ্গে একজন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে ১৪ টা মেডিকেল কলেজে শিশুদের ক্যানসার রোগের সেবা দেওয়ার জন্য। এ বিষয়টা আসলে গুরুত্বের সঙ্গে সব পক্ষের বিবেচনা করা প্রয়োজন।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়েট্রিক হেমাটোলাজি অ্যান্ড অনকোলজি (শিশু রক্তরোগ ও ক্যানসার) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যপক ডা. জোহরা জামিলা খান বলেন, ‘সম্প্রতি নতুন ২৮টি পদ সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও চিকিৎসক সংকট রয়েছে। আরও চিকিৎসক পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তাতে করে দেশের সব এলাকা থেকে রোগীদের আর ঢাকা ছুটে আসতে হবে না।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের মাঝে এখন সচেতনতা বেড়েছে আগের তুলনায়। আর তাই রোগীর চাপও বেড়েছে। অনেকে ঢাকায় এসে সিট না পেয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেকে অলটারনেটিভ চিকিৎসা নিয়ে কষ্টের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করছেন।’
ডা. জামিলা বলেন, ‘জনবল সংকটের বিষয়টি সমাধান করা একটা চ্যালেঞ্জ। ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য আধুনিক ল্যাব ও টেকনোলোজিস্টের অভাব আছে। রেডিওথেরাপি মেশিন চালু নেই সবজায়গাতে। সব হাসপাতালে কেমোথেরাপি মেডিসিন সরবরাহ নেই চাহিদা অনুযায়ী। এছাড়াও প্রশিক্ষিত নার্স, টেকনোলজিস্ট, এম এল এস এস, আয়া, ক্লিনার প্রয়োজন। তার পাশাপাশি আইসোলেটেড ওয়ার্ড এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র, ব্লাড এবং প্লেটিলেট সঞ্চালন কেন্দ্র জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সরকার এ অবস্থার পরিবর্তন তথা উন্নতি সাধনে নানা পরিকল্পনা নিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ চলছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে পারবেন যথাযথ কর্তৃপক্ষ। এরপর পরিবেশ কাজের উপযোগী হলে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শিশুদের বিশেষায়িত চিকিৎসা অবশ্যই দিতে পারবেন।’ খুব দেরি নয়, আমরা সুদিন দেখতে পাবো। শিশু ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা দিতে পারবো- আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডা. জামিলা।
বিএসএমএমইউ’র শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, ‘ক্যানসার কোনো সাধারণ রোগ নয়। সারা দেশে এখন সরকারি পর্যায়ে ৪৭ ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আছেন। ১৯৯৩ সালে ছিল একজন। প্রতি বছর বিএসএমএমইউ থেকে ৪ জন করে বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘শিশু ক্যানসারের চিকিৎসা সরকারি পর্যায়ে খরচ কম। বর্তমানে সরকার অনেক ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে। অনেক ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। মানুষের সচেতনতা ও মনের ইচ্ছা যাদের আছে, তারা ভালো হয়ে যাচ্ছে। বিএসএমএমইউতে শিশু ক্যানসারের ননপেয়িং বেড ৩১টি। এ ছাড়া তারা সাধারণ বেডেও ভর্তি হতে পারে। রোগীর যে চাপ ১০০ বেড হলে ভালো হয়।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন
সেন্টার ফর ক্যান্সার এপিডেমিওলজি, প্রিভেনশন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েকবছরে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় চিকিৎসকদের পদোন্নতি ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে যে সব পদ আছে সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম আগ্রহী পাওয়া যায়। এই জায়গাটাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ কাগজে কলমে আইন আকারে থাকলেও তার বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শিশু ক্যানসারের বিশেষজ্ঞ না থাকা বেশি দুর্ভাগ্যজনক। শিশুরা কিন্তু অনেক সময় ঝুঁকিতে থাকলেও তারা কিছু বলতে পারে না। আবার তাদের দেখে বড়রাও অনেক সময় কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এজন্য আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো শিশু ক্যানসার বিভাগ চালু ও সেখানে নিয়োগ দিয়ে সেগুলোতে রোগীদের সেবা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া প্রয়োজন। অন্তত একজন করে বিশেষজ্ঞ সেসব বিভাগে থাকা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষকে সচেতন হতে বলতে হয়তো বা তারা শুনবে কিন্তু বাচ্চাদের সচেতন করবেন কিভাবে? এটা কিন্তু চ্যালেঞ্জিং কাজ। যেখানে ঢাকাতেই অনেকে বুঝে না সেখানে প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক মানুষ শিশু ক্যানসারের বিষয়ে জানবেন না- এমনটাই তো স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় রোগ শনাক্তকরণে দেরি হয়ে যায়। শিশুদের যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা যায় তবে তাদের সুস্থতার হার কিন্তু বড়দের তুলনায় ভালো।’
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ রোবেদ আমিন ঢাকার বাইরে চিকিৎসা পাওয়া বিষয়ে বলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসায় দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাসপাতাল করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেখানে একটি করে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসা ইউনিট চালু থাকবে। কোমলমতি শিশুরা সেখানে চিকিৎসা নিতে পারবে।’
চিকিৎসক-সংকট সমাধান বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছেন। ইউনিট পুরোপুরি চালু হলে শিশু ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ দেখাবেন তরুণ চিকিৎসকেরা। বিশেষজ্ঞ তৈরিসহ বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক তৈরি হতে ৫ থেকে ৭ বছরের মতো লেগে যাবে। তাও আমরা আশাবাদী সমাধানের বিষয়ে যেন রোগীদের দুর্ভোগ কমানো যায়।’
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ক্যানসারে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ঘোষণা করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্তের হার ৬০ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে শিশু ক্যানসার রোগীদের যথাযথ পরিসংখ্যান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই।
এমন পরিস্থিতিতে শিশু ক্যানসার বিষয়ে গণমাধ্যমসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: সুস্থ হয় ক্যানসার আক্রান্ত শিশু, জানতে হবে ৩টি বিষয়
সারাবাংলা/এসবি/এমও
ক্যানসার চিকিৎসা চিকিৎসা শিশু ক্যানসার শিশু ক্যানসার চিকিৎসা