Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আলোচনায় কাগজ সংকট, বইয়ের দাম

আসাদ জামান
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১৮

অমর একুশে বইমেলার ১৬ তম দিন বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের গেট দিয়ে বেরিয়ে বইমেলার দিকে যাচ্ছিলাম। টিএসসি সংলগ্ন শহীদ ডা. মিলন সৌধের কাছে পৌঁছাতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। দুই হাতে চার ব্যাগ ভর্তি বই। বইমেলা থেকে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।

কথা বলতে চাইলে বিনা বাক্যব্যয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক।’

বিজ্ঞাপন

নাম জিজ্ঞেস করতেই নিজের পেশাগত পরিচয় কেন দিলেন, সেটা বোধগম্য নয়। হয়তো বা একজন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে শিক্ষক হিসেবে যেটুকু সৌজন্যতা তার প্রাপ্য, সেটুকু নিশ্চিত করার জন্যই! অতঃপর পুনরায় সালাম দিয়ে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলাম। পৃথিবীতে যত পেশা আছে, তার মধ্যে এই একটা মাত্র পেশার প্রতি মানুষের অন্তরে আজন্ম লালিত শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে।

যাই হোক, কথা কিছু দূর আগানোর পর জানা গেল পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকটি হচ্ছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জিটিএস মাদ্রাসার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক মো. জামাল উদ্দীন ভূঁইয়া। কোনো একটা কাজে ঢাকায় এসে বইমেলায় ঢুঁ মেরে গেলেন। অভ্যাসগত কারণে কিছু বইও কিনে নিলেন।

কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নোট নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু আলো স্বল্পতার কারণে তা মোটেও সম্ভব হচ্ছিল না। অথচা বইমেলা শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে. এম. মুজাহিদুল ইসলাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন— ‘মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় (সমগ্র মেলাপ্রাঙ্গণ ও দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ, মৎস ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এবং দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে চাঁনখারপুল, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত) নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে।’

বিজ্ঞাপন

ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট, শাহবাগ, চাঁনখারপুর, নীলক্ষেত তো দূরের কথা, টিএসসির আশপাশেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ গেটে সন্ধ্যার পর কাছে লোকটিকেও চোখে দেখা যায় না! আর বইমেলা কর্তৃপক্ষ গোটা ঢাকা শহর আলোকিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছে!

উপায়ন্ত না দেখে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধের দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে এক ফুটপাত দোকানির সোডিয়াম লাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক মো. জামাল উদ্দীন ভূঁইয়ার সঙ্গে কথা-বার্তা চলতে থাকল। যথারাীতি ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে কয়েকটা ছবিও তুলে নিলাম।

সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়’, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘কোরআনসূত্র’, মাওলানা আবদুল আউয়ালের ‘বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ’ এবং এমদাদুল হক চৌধুরীর ‘মহানবী ( সা.) এর চিঠি চুক্তি ভাষণ’— এই চারটি বই কিনে মোটেই সুখি হতে পারেননি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মো. জামাল উদ্দীন ভূঁইয়া।

আপসোসের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল প্রচুর বই কেনার। কিন্তু বইয়ের অত্যধিক দাম। সে কারণে মাত্র চারটি বই কিনে নিয়েই ফিরতে হচ্ছে।’

টিএসসি সংলগ্ন গেট দিয়ে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী অংশে প্রবেশের পর প্রথমে চোখে পড়ে এশিয়ান পাবলিকেশনের স্টল। চার ইউনিটের বিশাল আকৃতির এ স্টলে একজন ম্যানেজার এবং দুইজন বিক্রয়কর্মী ছাড়া আর কারও দেখা মিলল না। যেহেতু স্টল ফাঁকা, সেহেতু কথা বলার সুযোগটাও বেশি— এমন চিন্তা থেকেই প্রকাশনী সংস্থাটি ম্যানেজার মো. সোহাগ হোসেনের সঙ্গে রীতিমতো আড্ডা মেতে উঠলাম।

দীর্ঘ আলোচনায় সোহাগ হোসেন যেটা বললেন, সেটার সারামর্ম হচ্ছে- করোনার কারণে গত তিনটা মেলা খুব খারাপ গেছে। স্টল ভাড়া, সাজসজ্জা, খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া বিক্রয়কর্মীদের বেতন ভাতা বাবদ ব্যয়ই বইমেলা থেকে তোলা সম্ভব হয়নি। এবার তাদের প্রত্যাশা ছিল, প্রচুর বই বিক্রির মাধ্যমে গত তিন বছরের লোকসান পুষিয়ে নেওয়া। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ।

খারাপ কেন, বই বিক্রি হচ্ছে না?— বই গত বারের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে! কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে লস দিয়ে! এক শ’ টাকার কাগজ দুই শ’ টাকা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো চার শ’ টাকার বই ৮০০ টাকা বিক্রি করতে পারছি না। গতবারের চেয়ে ২০/২৫ শতাংশ দাম বাড়িয়েছি। তাতেই পাঠকের কাছ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসছে। সব মিলে এবারও খুব খারাপ যাবে।

এশিয়ান পাবলিকেশনের ম্যানেজার সোহাগ হোসেনের চেয়ে প্রথমা প্রকাশনের ম্যানেজার মো. জাকির হোসেনের হতাশার পারদ আরও কয়েক ডিগ্রি চড়া।

‘মেলার প্রথম সপ্তাহটা ভালোই গেছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে আমরা রীতিমতো হতাশ। কারণ, প্রথম সপ্তাহে বিগত বছরের প্রিন্ট করা বই আগের দামে বিক্রি করেছি। দ্বিতীয় সপ্তায় নতুন প্রিন্টের বই মেলায় এনেছি। এগুলোর দাম দেখেই পাঠকের চোখ কপালে উঠেছে। পাঠকদের বোঝাতেই পারছি না, কাগজের দাম এক লাফে দ্বিগুণ হয়েছে। বইয়ের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই’— বলেন জাকির হোসন।

তিনি বলেন, ‘মেলার বিন্যাসও এবার খারাপ। প্যাভিলিয়ন এবং স্টলের মাঝে এতো কম জায়গা রাখা হয়েছে যে, একটু ভিড় হলেই পাঠক এবং দর্শনার্থীরা দাঁড়াবার জায়গা পায় না। এরকম নানাবিধ প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবারের বইমেলা।’

পুরো বইমেলা জুড়ে পাঠক, প্রকাশক, ক্রেতা, বিক্রেতার কাছ থেকে এমন হাজারও অনুযোগ শোনা যাবে। আসলে জগতে কেউ সুখী নয়! বিক্রেতা বিক্রি করে ঠকছেন। অপরদিকে ক্রেতা ক্রয় করে ঠকছেন। একপক্ষ খেয়ে পস্তাচ্ছেন। অন্যপক্ষ না খেয়ে পস্তাচ্ছেন!

সন্ধ্যা গাঢ় হলে দূরের লোকের ঘরে ফেরার তাড়া থাকে বেশি। মিরপুর মণিপুরীপাড়া থেকে পরিবার নিয়ে মেলায় আসা আবু ইউসুফের মধ্যে তাই প্রচণ্ড তাড়া লক্ষ করা গেল। তবে মিসেস ইউসুফের আগ্রহ এবং ওয়াসিক আল জান্নাত (১০) ও ফৌজিয়া ইউসুফের (১৩) কৌতূহলের কারণে মিলে গেল কথা বলার সুযোগ।

কোথা থেকে মেলায় আসছ?— ৬০ ফিট থেকে। অর্থাৎ সড়কে প্রশস্তার মাঝে হারিয়ে গেছে বহু পুরোনো একটি স্থানের নাম! কী বই কিনলে?- আমি কিনেছি ‘বাইশের বন্যা’।

তরুণ কণ্ঠশিল্পী তাসরিফ খানের এই বইটি এবারের বইমেলায় ভালোই চলছে বোঝা যায়। বিশেষ করে ছোটদের মধ্যে কিছুটা হলেও কৌতূহল সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে ২০২২ সালের বন্যায় মানবিক কাজ করে আলোচনায় আসা সংগীত শিল্পী তাসরিফ খানের ‘বাইশের বন্যা’ বইটি।

ওদিকে ১০ বছর বয়সী ওয়াসিক আল জান্নাত কিনেছে মোস্তাক আহমাদের ‘ছোটদের মহানবী হযরত মুহাম্ম (সা.)’ বইটি।

ওয়াসিক আল জান্নাত ও ফৌজিয়া ইউসুফের মা খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘আমার বাচ্চারা স্মার্ট ফোন খুব একটা ধরে না। প্রচুর বই পড়ে। তাই বই কিনতে এসেছিলাম। বইয়ের দাম দেখে কেনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। একটা বিজ্ঞানবক্স আর দুইটা বই কিনে বাসায় ফিরছি।’

মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফরিদ আহমদ দুলাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মাহমুদ কামাল, নজিবুল ইসলাম এবং সাজ্জাদ আহসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অনীক মাহমুদ।

প্রাবন্ধিক বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে অর্থবহ করে তোলা যেমন জরুরি, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনে সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করাটাও অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সকল স্তরে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে সমন্বয় করতে হবে। দেশের মাঠপর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়, কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নটি এবং সেখানেই বাংলা, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণের সৌন্দর্য লুকায়িত। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ তখনই অর্থবহ হবে, যখন লোকবাংলার শুভ প্রবণতার চেতনা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে লোক মানস থেকে নীতিনির্ধারকদের কাছে।’

আলোচকরা বলেন, বিকেন্দ্রীকরণের একটি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক দিক আছে। ভাষাগত দ্বান্দ্বিকতার মতো বিষয়গুলো সমাধা করার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগে সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকেন্দ্রীকরণের জন্য দেশব্যাপী বিদ্যমান সাংস্কৃতিক অবকাঠামোগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক বিভেদের বদলে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম পূর্বশর্ত।

সভাপতির বক্তব্যে অনীক মাহমুদ বলেন, ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতির মূল শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিই একটি জাতির মূল শক্তি। সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের মানুষদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ইসরাইল খান, মাসুম রেজা, রিপন আহসান ঋতু এবং জুনান নাশিত।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন আমিনুর রহমান সুলতান, আয়শা ঝর্না, শিহাব শাহরিয়ার, অংকিতা আহমেদ রুবি, ফরিদুজ্জামান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ শহীদুল ইসলাম, জেসমিন বন্যা, নূরুননবী শান্ত।

এছাড়া ছিল সিরাজুল মোস্তফা-এর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাইজভাণ্ডারী মরমী গোষ্ঠী’ এবং মো. আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন, সেলিম চৌধুরী, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শ্যামল কুমার পাল, সনৎ কুমার বিশ্বাস, মেহেরুন আশরাফ, বাবু সরকার এবং মো. আরিফুর রহমান। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন চন্দন দত্ত (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), গাজী আব্দুল হাকিম (বাঁশি), শেখ জালাল উদ্দীন (সেতার)।

আগামীকাল ৪ঠা ফাল্গুন, ১৭ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। অমর একুশে বইমেলার ১৭তম দিন। মেলা শুরু হবে সকাল ১১ টায়, চলবে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত। এরমধ্যে সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে। এছাড়া সকাল ১০ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবার্ষিক ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মহীবুল আজিজ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অনিরুদ্ধ কাহালি ও মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ আকরম হোসেন।

সারাবাংলা/এজেড/একে

অমর একুশে বইমেলা বইমেলা ২০২৩

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর