Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বইমেলায় চিন্তা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার প্রদর্শনী

আসাদ জামান
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:২৭

বইমেলার একেবারে মাঝ বরাবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে চার বন্ধুকে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র মেহেদী হাসান লিমন গলা ছেড়ে গাচ্ছেন, ‘মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা/মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা/হন হারনে ভালবাসার দাম ন দিলা/হন দোষখান পায় ভালবাসার দাম ন দিলা/ আশাই আঁচিল তোয়ারে লয় বাইন্দুম একখান সুখেরি ঘড়/আশাই আঁচিল তোয়ারে লয় বাইন্দুম একখান সুখেরি ঘড়/সুখের বদলে দুক্কু দিলা/সুখের বদলে দুক্কু দিলা/হন হারনে ভালবাসার দাম ন দিলা/ হন দোষখান পায় ভালবাসার দাম ন দিলা/প্রেম নদী….তে অইনুর টানত আরে কেন ফেলাই গেলা/প্রেম নদি…..তে অইনুর টানত আরে কেন ফেলাই গেলা/এনগরি কেন ভুল বোঝিলা/এনগরি কেন ভুল বোঝিলা/হন হারনে ভালবাসার দাম ন দিলা/হন দোষখান পায় ভালবাসার দাম ন দিলা।’

বিজ্ঞাপন

চাইনিজ বাদ্যযন্ত্র ইউকেলেলে (বাংলাদেশি বাদ্যযন্ত্র দোতরা গোত্রীয়), মোরাক (ছোট গিটার বিশেষ), কাজু (বাঁশি বিশেষ) এবং মন্দিরা বাজিয়ে পাঁচ বন্ধুর এই নিটোল পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে একদল লোক। বেশ কয়েকজন ইউটিউবারও তাদের ঘিরে রেখেছে। শ্রোতা এবং ইউটিউবারদে এমন উপচে পড়া ভিড় দেখে ‘জিরো ডিগ্রী’ ব্যান্ডের তরুণ এই শিল্পীরা দিগুণ উৎসাহে গানটা গেয়ে শেষ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু করতালি।

বিজ্ঞাপন

স্বরের চেয়ে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ উঁচু হলে গানের কথা বোধগম্য হয় না। মানুষকেও আকৃষ্ট করে না। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ স্বরের চেয়ে নিচে থাকলে গায়কের গায়ীকি বা গান গাওয়ার ধরন ও শৈলী সম্পর্কে সাধারণ শ্রোতারাও দ্রুত ধারণা নিতে পারে। সে কারণেই হয়তো ইউকেলেলে, মোরাক, কাজু ও মন্দিরার শান্ত মেজাজের বাদ্যযন্ত্রযোগে গাওয়া মেহেদী হাসান মিলন, জুবায়ের জয়, এস এম সাব্বির ও সাকিবের মতো ‘অখ্যাত’ শিল্পীর গাওয়া গান এতো আগ্রহের সঙ্গে শুনছিলেন বইমেলায় আসা পাঠক ও আড্ডাবাজ মানুষগুলো।

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসব। বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক জাগরণ-উন্মুখ পরিবেশ তৈরি হয়। দেশের মানুষের চিন্তা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার প্রদর্শনী হয় বইমেলায়। এরই ফলশ্রুতিতে শিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মেহেদী, সাব্বির, জুবায়েরা বেছে নেন বইমেলার উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম।

বইয়ের মেলায় গানের আয়োজন কেন?— লিড ভোকাল মেহেদী হাসান মিলনের সাবলীল উত্তর, ‘আমরা তো মনে করি বইমেলা শুধু বই বিক্রির জন্য না। এটা সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসব। এটা পার্থিব লাভালাভের চেয়ে আত্মার মুক্তি খোঁজার বড় ক্যানভাস।’

আসলেই তাই। প্রতিদিন মেলায় আসা হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষ হয়তো বই কেনে। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষ চিন্তা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার প্রদর্শনীতে শরিক হতে। সুকুমার প্রবৃত্তি স্বরূপে জাগিয়ে তুলতে বেশিরভাগ মানুষের বইমেলায় আসা।

মূল বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত ১০ বছর ধরে। তবে মূলমঞ্চ রয়ে গেছে তার পুরোনো ঠিকানায়। অর্থাৎ বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের পূর্ব বেদীতে। সে কারণেই হয়ত বইমেলায় বই কিনতে আসা পাঠকটিও একবারের জন্য হলেও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুঁ মেরে যায়। ফলে সন্ধ্যার পর বইমেলার মূলঞ্চের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য ছোট-খাটো একটা ভিড় লক্ষ্য করা যায় প্রায় প্রতিদিনিই।

শনিবারের সন্ধ্যাটা এর ব্যতিক্রম ছিল না। মূল মঞ্চের সামনে রাখা প্রায় সবগুলো চেয়ার শ্রোতায় পরিপূর্ণ। আবৃত্তি শিল্পী মছরুর হোসেনের কণ্ঠে ‘রক্তাক্ত বর্ণমালা’ কবিতার আবৃত্তি শেষে আজিজুল বাসার যখন শুরু করলেন, ‘যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ/দরিয়ানগরে জন্ম, পৃথিবীর সর্ব প্রান্ত আমার স্বদেশ/এ বাংলার হাটে মাঠে, ধানীরং কিষাণীর বাটে/দিগন্তের মেঠোপথে, সাধু সন্ত অথবা বখাটে/নদী ও নারীর বাঁকে পাখপাখালির ঝাঁকে/হাজার বছর ধরে জীবনের আনন্দরা হাঁটে/শাম্পান ভাসায় তারা আঁশনাই দরিয়ার তরঙ্গে অশেষ/ যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ’ তখন যেন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল মূলমঞ্চে।

 

কবিতাও যে মানুষকে বেঁধে রাখতে, তার একটা জ্বলন্ত উদহারণ তৈরি হলো জাতি সত্ত্বার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘যত দূর বাংলা ভাষা’ কবিতাটি আবৃত্তির সময়। আবৃত্তিকার আজিজুল বাসারের হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তি উপস্থিত দর্শকদের যেন বৈকুণ্ঠের দিকে নিয়ে গেল।

বইমেলায় যে কত প্রকারের লোক কত উদ্দেশ্য নিয়ে আসে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে এমন সব ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, যা অবাক করে দেওয়ার মতো!

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভবনের লিফটে দেখা মোহম্মদপুর আন নূর ইসলামীয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নোমান ইবনে রেজার সঙ্গে। ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের’ ছাত্র নোমান এসেছেন ‘শ্রীমদ্ভগবত গীতা’ কেনার জন্য। বইমেলায় বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নে ‘শ্রীমদ্ভগবত গীতা’ না পেয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভবনে বাংলা একাডেমির বই বিক্রয় কেন্দ্রে খোঁজ নিতে এসেছিলেন তিনি। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে তৃতীয় তলায়!

কওমী মাদ্রাসায় ছাত্র ‘শ্রীমদ্ভগবত গীতা’ কিনতে বইমেলায়! নোমান ইবনে রেজা আরও অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘বাইবে ‘, ‘ত্রিপটক’, ‘শ্রীমদ্ভগবত গীতা’— সব কিছুই আমাদের পড়তে হয়। আর পড়তে হলে তো এগুলো কিনতে হবে। কাছেও রাখতে হবে।’

মেহেদী হাসান মিলনের ও তার বন্ধুদের গান, আজিজুল বাসারের আবৃত্তি, কওমী শিক্ষার্থী নোমান ইবনে রেজার ‘শ্রীমদ্ভগবত গীতা’ কেনার দিনে বইমেলায় নতুন বই এসেছে ১৭০টি। বিক্রিও হয়েছে বেশ। ‘বাংলানামা’ প্রকাশনীর বিক্রকর্মী মেরিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত দুই দিন আমরা অনেক বই বিক্রি করেছি। কবি প্রতীক মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘শূন্যের শহরে বায়োস্কোপ ভোর’ বইটি বেশি বিক্রি হয়েছে।’

পাললিক সৌরভের বিক্রয়কর্মী এইচ এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল এবং আজ অনেক বই বিক্রি করেছি আমরা। এবারের বইমেলায় সেরা দুইটা দিন পার হল আমাদের।’

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

সকাল ১১ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত ছিল। সকাল ১০ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ক-শাখায় ১ম হয়েছেন নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির, ২য় হয়েছেন অন্বেষা মজুমদার এবং ৩য় হয়েছেন সার্থক সাহা। খ-শাখায় ১ম হয়েছেন রোদোসী নূর সিদ্দিকী, ২য় হয়েছেন তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় এবং ৩য় হয়েছেন মৈত্রেয়ৗ ঘোষ। বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন শিল্পী মাহমুদ সেলিম, সুজিত মোস্তফা এবং চন্দনা মজুমদার।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গোলাম মুস্তাফা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোহিত কামাল ও রাজীব কুমার সরকার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুব্রত বড়–য়া।

প্রাবন্ধিক বলেন, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শিক্ষকতা ও গবেষণার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, আমাদের সমাজ রাজনীতির বিকাশ ও ঘটনাপ্রবাহের দিকে তিনি বরাবরই মনোযোগী ছিলেন। সমাজ ও জাতীয় জীবনের ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি শুধু আগ্রহীই ছিলেন না, এসব বিষয়ে তিনি নির্ভয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং আমাদের জন্য দিকনির্দেশও প্রদান করেছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তো বটেই, শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের মানুষ ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন পরামর্শক ও পথপ্রদর্শক।

আলোচকবৃন্দ বলেন, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মুক্তমনের মানুষ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হয়েও তিনি কেবল সাহিত্যের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে কখনও আচ্ছন্ন হননি বলেই সত্যনিষ্ঠ কথনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এ বিষয়টি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে উপলব্ধি করেছেন তিনি। মাতৃভাষার শিক্ষাগ্রহণের ওপর তিনি সবসময়ই জোরারোপ করেছেন।

সভাপতির বক্তব্যে সুব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবনাচারের সঙ্গে বিনয় ও স্বচ্ছতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। তিনি যেমন এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করেছেন, তেমনি নিজের শিক্ষাদর্শনটিও তুলে ধরেছেন। যে শিক্ষা আমাদের জীবনকে বহুমাত্রিক করবে, এমন শিক্ষার কথাই তিনি ভেবেছেন।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ওবায়েদ আকাশ, রনজু রাইম, ফারুক সুমন এবং হক ফারুক আহমেদ।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন জামিরুল ইসলাম শরীফ, নীপা চৌধুরী, তাহমিনা কোরাইশী, রাসেল মাহমুদ এবং হোসাইন কবীর। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী, মছরুর হোসেন, আজিজুল বাসার, তনুশ্রী মল্লিক। এছাড়া ছিল মৈত্রী সরকারের পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘স্বপ্নবিকাশ কলা কেন্দ্র’, মুজাহিদুল ইসলামের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘তারুণ্যের উচ্ছ্বাস’, মুশতাক আহমেদ লিটনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আমরা কুঁড়ি’, মিতা মোস্তফার পরিচালনায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কৃষ্টিবন্ধন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটি’-এর পরিবেশনা। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন জয় সিংহ রায় (তবলা), শ্যামা প্রসাদ মজুমদার (কি-বোর্ড)।

আগামীকাল ৬ই ফাল্গুন, ১৯ ই ফেব্রুয়ারি রোববার। অমর একুশে বইমেলার ১৯তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত।

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে গোবিন্দচন্দ্র দেব এবং ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গাজী আজিজুর রহমান এবং আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন খান মাহবুব, হাসান অরিন্দম, শিহাব শাহরিয়ার, পাপড়ি রহমান, রাজীব কুমার সরকার। সভাপতিত্ব করবেন আবু মো. দেলোয়ার হোসেন।

সারাবাংলা/এজেড/একে

একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০২৩

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর