নতুন পাঠকে বর্ণিল বইমেলা
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:২৯
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারার দুই লেখক এমদাদুল হক মিলন এবং প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে এক সময় বইমেলার স্টলগুলোতে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যেত। ‘সেলফি যুগের’ আগে অটোগ্রাফ শিকারিদের সেই ভিড় বইমেলার অন্যতম আকষর্ণ বা অলংকার হিসেবে বিবেচিত হতো।
হুমায়ূন আহমেদ নেই। এমদাদুল হক মিলনের জনপ্রিয়তাও ভাটার দিকে। ফলে বইমেলায় স্টল-প্যাভিলিয়নে আগের সেই ভিড় এখন আর দেখা যায় না। মানসম্মত বইয়ের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টল-প্যাভিলিয়নে প্রবীণ ও সিরিয়াস পাঠকদের শান্ত-সৌম্য ভিড় এখন বইমেলার নিত্য দিনের দৃশ্য।
কিন্তু রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলার ১৯তম সন্ধ্যায় তাম্রলিপি’র প্যাভিলিয়নে দেখা মিলল ভিন্ন চিত্র। প্যাভিলিয়নটির চারপাশ ঘিরে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এবং শিশুদের ভিড়। বিশেষ করে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী বইকেনা ও সেলফি উৎসবে মেতে উঠেছে।
কিশোর-কিশোরীদের এই মাতামাতি মূলত তাদেরই বয়সী কিশোর লেখক অন্তিক মাহমুদ এবং তার ‘দুইশ পঞ্চাশ’ বইটি নিয়ে। বইয়ে কী আছে, অথবার বইটির বিষয়বস্তু কী, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তাম্রলিপির দুই বিক্রয়কর্মী বললেন, ‘এটা নিয়ে কথা বলা বারণ আছে।’
মিরপুর থেকে স্ত্রী এবং ১১ বছর বয়সী কন্যা ঐশ্বর্য্যকে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন লিটন রিচার্জ ক্রুজ। বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আর আশপাশের স্টল ও প্যাভিলিয়ন থেকে পছন্দের বই কিনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার স্ত্রী এবং কন্যা।
মেয়ের জন্য কী বই কিনলে?— এমন প্রশ্নের জবাবে লিটন রিচার্জ ক্রুজ বললেন, ‘ওর (ঐশ্বর্য) বই ও নিজেই পছন্দ করছে, নিজেই কিনছে। সঙ্গে ওর মা আছে। সুতরাং না দেখে বলতে পারব না, আজ ওরা কী বই কিনেছে।’
এরপর ব্যাগ থেকে একেক করে বের হতে লাগল, হুমায়ূন আহমেদের ‘মিসির আলি UNSOLVED’, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘বন বালিকা’, ‘রাশা’, ‘ফেরা’, শঙ্কর রায়ের ‘শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত স্বরলিপি’, ফোরকান আহমদের ‘নিজেকে বদলাতে হবে’ বইগুলো।
শুধু তাম্রলিপিতে মৌমাছির মতো ভিড় করে থাকা কিশোর-কিশোরী অথবা হুমায়ূন আহমেদ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালে বুঁদ হয়ে থাকা ১১ বছর বয়সী ঐশ্বর্য নয়, অমর একুশে বইমেলার ঊনচল্লিশতম আসর জুড়েই নতুন পাঠকদের ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। মোট বিক্রি হওয়া বইয়ের বড় একটা অংশের ক্রেতা হচ্ছে তরুণ-তরুণ, কিশোর-কিশোরী এবং শিশুরা।
বইমেলা থেকে অন্যরা খালি হাতে ফিরলেও এই শ্রেণিটা বই কিনেই বাসায় ফিরছে। বাবা-মা’র সঙ্গে বইমেলায় এসে বই না কিনে ঘরে ফেরা শিশু-কিশোরের সংখ্যা খুবই কম। এসব নতুন পাঠকের উপস্থিতি অমর একুশে বইমেলাকে বর্ণিল করে তুলছে।
আশা জাগানিয়া এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ‘কথা প্রকাশন’র ইনচার্জ মো. ইউনুস আলীর সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে রকিব হাসানের ‘স্বপ্ন তরী’, মুস্তাক আহামেদের ‘নয়ন চাঁদ’সহ কিশোর ক্লাসিকগুলো। আর এসব বইয়ের পাঠক মূলত শিশু এবং কিশোররা। এছাড়া হরিশংকর জলদাসের ‘কর্ণ’ উপন্যাসটিও ভালো বিক্রি হচ্ছে।
রোববার বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৭৫টি। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ ১১টি, উপন্যাস ১০টি, প্রবন্ধগ্রন্থ তিনটি, কাব্যগ্রন্থ ২১টি, গবেষণা গ্রন্থ দুটি, শিশু সাহিত্য একটি, জীবনী গ্রন্থ একটি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ একটি, বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ একটি, ভ্রমণগ্রন্থ একটি, ইতিহাস গ্রন্থ একটি, রাজনীতি গ্রন্থ একটি, রম্য রচনা একটি, ধর্মীয় গ্রন্থ দুটি, অনুবাদ গ্রন্থ আটটি, অভিধান একটি, সায়েন্স ফিকশন একটি এবং অন্যান্য পাঁচটি।
মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় গোবিন্দচন্দ্র দেব এবং ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গাজী আজিজুর রহমান এবং আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশ নেন খান মাহবুব, হাসান অরিন্দম, শিহাব শাহরিয়ার, পাপড়ি রহমান এবং রাজীব কুমার সরকার। সভাপতিত্ব করেন আবু মো. দেলোয়ার হোসেন।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন আমৃত্যু মানবহিতৈষী বন্ধু, প্রাজ্ঞপণ্ডিত, মানবদরদি মহাপ্রাণ এবং অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। দার্শনিক তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, দার্শনিক হিসেবে তিনি বৃত্তে থেকেও মুক্ত। তার দর্শন তাই দৈশিক ও বৈশ্বিক। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা গাজীউল হক কর্মজীবনে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেও রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। রাজনৈতিক জীবনে কোনো প্রকার লোভ ও মোহ যেমন তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, তেমনি কর্মজীবনেও তিনি ছিলেন মোহমুক্ত একজন মানুষ।
আলোচকরা বলেন, গোবিন্দচন্দ্র দেব দর্শনকে কেবল শাস্ত্রে নিবদ্ধ না রেখে ব্যবহারিক জীবনে দর্শনের প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। দর্শনের মতো জটিল বিষয়কে তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, ফলে তার দর্শনের গ্রন্থগুলো সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। উদার ও অসাম্প্রদায়িক গোবিন্দচন্দ্র দেবের, অহিংস ও সমন্বয়বাদী দর্শন আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক। অন্যদিকে দেশ-মাটি ও মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রামী গাজীউল হক ছিলেন একাধারে গীতিকার, সাহিত্যিক, কবি, রাজনীতিক। বাঙালির ইতিহাসের চরম উৎকণ্ঠাময় সময়ে ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসে তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
সভাপতির বক্তব্যে আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গোবিন্দচন্দ্র দেব ও ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক দু’জনেই ছিলেন মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমিক। তাদের জীবন-কর্ম ও চিন্তাচেতনা দেশ-জাতি ও মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কামরুল হাসান, ফজলুর রহমান, জেবউননেছা এবং শিবুকান্তি দাশ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন নূরুন্নাহার শিরীন, সরকার মাসুদ, কাজী আসাদুজ্জামান, কাজী আনারকলি, হাসান শরীফ এবং আসাদ কাজল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, রূপশ্রী চক্রবর্তী, দেবাশিস্ রুদ্র এবং ঝর্ণা পারুল। এছাড়া ছিল আতিকুর রহমান উজ্জ্বলের পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘নৃত্যাঙ্গন’, শামীম চৌধুরী শ্যামলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী’, মোশাররফ হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দৃষ্টি’, মানজারুল ইসলাম সুইট‘র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা, জান্নাত-এ-ফেরদৌসী, স্নিগ্ধা অধিকারী, মঞ্জু সাহা, সুমন চৌধুরী এবং উত্তম কুমার রায়। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন এনামুল হক ওমর (তবলা), ডালিম কুমার বড়–য়া (কি-বোর্ড), মো. মনিরুজ্জামান (বাঁশি), নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)।
আগামীকাল ৭ ফাল্গুন, ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার। অমর একুশে বইমেলার ২০তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন নূরুননবী শান্ত। আলোচনায় অংশ নেবেন মিহির মুসাকী, বেলাল হোসেন, হোসেন আল মামুন। সভাপতিত্ব করবেন লুবনা মারিয়াম।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম