দুর্গম পাহাড়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, হাজারও ত্রিপুরা পেল সেবা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, তেন ত্রিপুরার বয়স ১০০ বছর। পাহাড়-প্রকৃতির সন্তান তিনি, শরীর না চললেও মনের জোরে হাঁটাচলা করেন এখনও। শুধু চোখের আলোটুকুই নেই। এসেছিলেন বিনামূল্যের স্বাস্থ্য ক্যাম্পে। চিকিৎসা পেয়েছেন, বিনামূল্যে চোখের অস্ত্রোপচারের পথও দেখিয়ে দিয়েছেন একদল চিকিৎসক।
চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় এক দুর্গম পাহাড়ে ত্রিপুরা পাড়ার হাজারো মানুষ মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দিনভর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা পেয়েছেন, সঙ্গে বিনামূল্যে ওষুধও।
মীরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের নলখো ত্রিপুরা গ্রামে ‘এসএসসি-২০০২ ও এইচএসসি-২০০৪ ব্যাচ’র উদ্যোগে এ সেবার আয়োজন করা হয়। উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
সেই তেন ত্রিপুরা থাকেন নলোক ত্রিপুরা পারায়। নিজের ৭০ বছর বয়সী ছেলে রতন ত্রিপুরার হাত ধরে এসেছিলেন চোখের চিকিৎসা নিতে।
তেন ত্রিপুরা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের মতো চোখে দেখতে পাই না। রাস্তাঘাট নেই, ডাক্তারের কাছে যেতে পারি না। যখন শুনেছি, এখানে ডাক্তার আসবে, তখন ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে এলাম। এখন ডাক্তার বলছে চোখের ছানি অপারেশন করাতে হবে। তারাই শহরে নিয়ে যাবে। অপারেশন করে আবার বাড়ি নিয়ে আসবে।’
বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়ে কেমন লাগছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ভালো লাগছে। অর্থের অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় আমাদের এলাকার অনেকেই চিকিৎসা করাতে পারেন না। এখন আমাদের কাছে চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তাররা এসেছেন। বিনামূল্যে ওষুধও দিচ্ছেন।’
প্রায় ৫২ বছর বয়সী পুষ্পা রাণীর বেশ কিছুদিন ধরেই শরীর ব্যথা, গা কাঁপিয়ে জ্বরও আসে। এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে। ডাক্তার দেখিয়ে লাইন ধরে নিয়েছেন ওষুধ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকমাস ধরে শরীরটা খুব খারাপ। ডাক্তার দেখেছেন, ওষুধ দিয়েছে, টাকা নেয়নি। তাদের মঙ্গল হোক।’
সুবিধাবঞ্চিতদের সেবা দেওয়া মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে ৩০ জন ডাক্তার আছি। কেউ মেডিসিন, কেউ শিশু আবার কেউ হৃদরোগের। প্রতিবছর এ ক্যাম্পটি হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এবার এখানে হচ্ছে। মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে পারার মধ্যে একটি আনন্দ লুকিয়ে থাকে।’
ফ্রি হেলথ ক্যাম্প-২০২৩ এর আহ্বায়ক জনি ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাম্পে ২৩টি বুথের মাধ্যমে ৩০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিয়েছেন। শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবা নয়, এখানে যারাই এসেছেন, তাদের জন্য রাখা হয়েছে কাপড়, শাকসবজি। সবাই নিয়েছেন। বিনামূল্যে ওষুধও নিয়েছেন। যাদের চোখের সমস্যা তারা নগরীর লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে বিনামূল্যে অপারেশন করতে পারবেন। আমাদের দেয়া বাসে করে তাদের নেয়া হবে। অপারেশনের পর পৌঁছে দেওয়া হবে।’
মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতদের জন্য আমাদের ব্যাচ প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প করে। আজকের এই ক্যাম্পে এক হাজারের বেশি মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। ৮০০ মানুষকে দেওয়া হয়েছে কাঁচাবাজার ও পোশাক। আর ৪০ শিশুকে খৎনা করা হয়েছে। অনেকেই বলেন এসব অর্থের যোগান কোথা থেকে হয়। সারা বাংলাদেশে আমাদের ব্যাচের যারা আছে সবাই নিজেদের পকেটের টাকা এখানে দিই। সেই টাকা দিয়ে এসব সেবা করি। সামনেও করব।’
২০০২ সালে এসএসসি ও ২০০৪ সালে এইচএসসি ব্যাচের ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পুরো আয়োজন তত্ত্বাবধান করেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা অর্ণব বড়ুয়া।
এদিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। অনেকেই নানাভাবে টাকা-পয়সা উপার্জন করে থাকেন। তবে মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন না তেমন কেউ। একদিন আমরা সবাই মারা যাব। তখন এসব টাকা কী কবরে নিয়ে যাব? এক টাকাও কেউ নিতে পারবে না।
‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। আজ এই আয়োজন যারা করেছে ,হাজার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে, ওষুধ দিচ্ছে সবাই যদি তাদের মতো মানবিক হয় তাহলে মানুষ হিসেবে নিজেকে আমরা পরিচয় দিতে পারব।’
মীরসরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিনের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান, উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, মীরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন এবং ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্পের’ আহ্বায়ক জনি ঘোষ।
অনুষ্ঠানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিল্পীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী হোজাগিরি নৃত্য পরিবেশন করেন।
সারাবাংলা/আইসি/একে