দুদক কমিশনারের বাড়ির ইট খুলে ফেলার হুমকি মাইজভাণ্ডারী এমপির
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৪২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুই ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর বেজায় ক্ষেপেছেন চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য ত সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল তরীকত ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ ময়দানে এক আলোচনা সভায় সংসদ সদস্য নজিবুল বশর দুদকের পাশাপাশি সরকারকে উদ্দেশ্য করেও বিভিন্ন কথা বলেন। নজিবুলের পিতা প্রয়াত সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
এর আগে, রোববার নজিবুল বশরের দুই ছেলে সৈয়দ তৈয়বুল বশর ও সৈয়দ আফতাবুল বশরসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে— প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে সৈয়দ তৈয়বুল বশর ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর ২০ কোটি টাকা এবং সৈয়দ আফতাবুল বশর ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা শর্তসাপেক্ষে পাঁচবছর মেয়াদী ঋণের জন্য আবেদন করেন।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, আবেদনের দুইদিন আগেই প্রাইম ফাইন্যান্সের বোর্ড সভায় ঋণ দুটি অনুমোদন হয়। এ ছাড়া ঋণ মঞ্জুরে নানা অনিয়মও হয়েছে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দুদক আরও দেখতে পায়, ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা এই ঋণ নেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তাসহ এমপিপুত্ররা ঋণের শর্ত ভঙ্গ করে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।
এরপর সোমবার রাতে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে আলোচনা সভায় দুদকের মামলা নিয়ে নজিবুল বশর ও তার বড় ছেলে তৈয়বুল বশরের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সভায় উপস্থিত মাইজভাণ্ডার ভক্তদের উদ্দেশে সৈয়দ নজিবুল বশর বলেন, ‘মামলা করেছে, কী মামলা? ৩৯ কোটি টাকা, এর চেয়ে কিছু বেশি। ধরেন, ৪০ কোটি টাকা নিলাম। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকা জমা দিলাম, তাহলে সেটি কী আত্মসাৎ হয়? ১০ কোটি টাকা যে জমা হয়েছে দুদক সেটা মামলায় উল্লেখ করেনি। দুদক নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এমপিকে চিনে নাই, যা-তা কমেন্ট করতেছে সহকারি পরিচালক, চামড়া সব তুলে ফেলব। মাইজভাণ্ডারের গায়ে হাত!’
দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের নাম উল্লেখ করে তাকে উদ্দেশ্য করে সংসদ সদস্য বলেন, ‘কমিশনার মোজাম্মেল সাহেব, আপনি সাইন (স্বাক্ষর) করেছেন। শোনেন- আপনার বাড়ি মাদারীপুর। আমি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে (যুদ্ধাপরাধী) বলেছিলাম- মাইজভাণ্ডার ভক্তদের বললে আপনার বাড়ির একটা ইটও থাকবে না, যদি আমরা ফতোয়া দিই, তোমার বাড়ির ইট সব খুলে নিয়ে আসবে। এটা আমি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বলেছিলাম। একই কথা আপনাকেও (দুদক কমিশনার) বলছি।’
উচ্চ আদালতে দুদকের মামলা চ্যালেঞ্জ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রিট করব। যদিও আমাকে নিষেধ করা হয়েছে, তবুও আমি রিট করব। আমার জন্য, আমার ছেলের জন্য মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ কলঙ্কিত হলে আমার তো মরে যাওয়া উচিত। এটি শুধু রাজনীতির জন্য বলিনি। সব জায়গায়, টিভির স্ক্রলে, পত্রিকায় লিখেছে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, নামের পাশে মাইজভাণ্ডারী লিখেছে। এ জন্য রিট করব। কারণ মাইজভাণ্ডারের একটি সেন্টিমেন্ট আছে। তাই আমি হাইকোর্টে রিট করব। দুদককে চ্যালেঞ্জ করবে।’
মামলায় কিছুই হবে না— এমন মন্তব্য করে নজিবুল বশর বলেন, ‘আমি জানি, এই মামলায় কিছুই হবে না। আমার ছেলে বলছে, এই মামলায় কী হবে জানি না। আমি জানি এই মামলা মরা, কিছুই হবে না। মিডিয়া শুধু শুধু অতিরঞ্জিত করে ফেলতেছে। আমরা টাকা মেরে খাই নাই। এখানে দুদক যা বলে তা, কিছু বলতে পারবে না। আর কেউ এটি নিয়ে কথা বলতে পারবে না। চরিত্রহনন করছে, দুদক করছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। দুদকের সঙ্গে কে জড়িত সেটি সরকার বের করুক।’
হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ এটি আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণকেন্দ্র। মাইজভাণ্ডারকে বির্তকিত করার চেষ্টা চলছে। আমাকে সাইজ করার চেষ্টা চলছে, সাইজ নিজেরা হয়ে যাবেন। মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবেন না। এখানে যারা হাত দিয়েছে, তাদের হাত পুড়ে গেছে।’
সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই মন্তব্য করে নজিবুল বশর বলেন, ‘আমার ছেলে একটা কথা বলেছে। সরকারের সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নাই, এটি ভুল তথ্য। আমি ১৪ দলের জোটে আছি, এখনও আছি। সরকারের জায়গায় সরকার আছে। আমি বিশ্বাস করি সরকার এটি করেনি। কেউ চেষ্টা করছে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব করার জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আপনি বের করেন কারা এটি করছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে সহযোগিতা করতে বলেছিলেন জানিয়ে তরিকতের এই নেতা বলেন, ‘সহযোগিতা তো করেছি। এখনও করে যাচ্ছি। কওমি মাদরাসার সাথে গণ্ডগোল, আমি সরকারকে সহযোগিতা করেছি। করি নাই? সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি কী অবস্থা করেছিল? আমেরিকা কি করেছিল? সেটি ঠেকিয়েছে কে? সরকার আপনি? একমাসও হয়নাই আপনার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি আপনাকে বলেছি, এবারও আপনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, নির্বাচন হয়ে যাবে। আল্লাহ চাইলে এই ফটিকছড়ি থেকে আমি আবার নির্বাচন করব।’
‘মুখ খোলায়েন না, মুখ খুললে অসুবিধা হয়ে যাবে। আমি সেই ব্যক্তি যে জামাতের নিবন্ধন বাতিল করিয়েছি। আমার সাহস হয়েছে, আপনাদের সাহস হয়নাই নিজামী -মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। আল্লাহর নবীর শানে বেয়াদবির জন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করেছি। তাদের জেলে ঢুকিয়েছি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে। যদি আমি না থাকতাম, আপনারা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতেন না। তাদের ফাঁসিও হতো না।’
এমপি পদ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘যারা আমার এমপি পদ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, তারা মাজারবিরোধী, তরিকতবিরোধী, মাইজভাণ্ডারবিরোধী, আহলে সুন্নত বিরোধী। তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রকাশ্যে গালি দিয়েছে। এই জায়গায় আমি বাধা দিয়ে যাব। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই না। মৃত্যুর ভয় নেই। কেউ কেউ ভুলে গেছে মাইজভাণ্ডারী কে? আমার জন্য অনেক দেশ কথা বলবে।’
‘বিএনপিকে ঘরে ঢোকানো সম্ভব, নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে না। এটা ১৯৯১ সাল না, ২০২৩ সাল। ওইদিন চলে গেছে। সরকার আসবে-যাবে, আমার অবস্থান ঠিক থাকবে।’
সভায় সংসদ সদস্যের ভাই হাবিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবং ছোট ছেলে সৈয়দ আফতাবুল বশরও বক্তব্য রাখেন বলে জানা গেছে।
প্রায় ১৫০ বছর আগে আধ্যাত্মিক সাধক সৈয়দ আহমদ উল্লাহর প্রতিষ্ঠা করেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ। সেই সাধকের বংশধরদের মধ্যে একজন সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। আশির দশকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত নজিবুল ১৯৯১ সালে দলের মনোনয়নে প্রথমবার ফটিকছড়ি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু সেই সংসদেই দল বদল করে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ২০০৫ সালে বিএনপি ছেড়ে নজিবুল বশর তরিকত ফেডারেশন নামে একটি দল গঠন করে জামায়াত ইসলামীর জোরালো বিরোধিতা শুরু করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে দু’টি আসন পায়, যার একটির সংসদ সদস্য নজিবুল বশর। ২০১৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের একাংশ তরিকত ফেডারেশনের সাংসদ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন।
সারাবাংলা/আরডি/একে