একুশেও পূরণ হলো না বই বিক্রির প্রত্যাশা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৩৬
‘পলল প্রকাশনী’র স্বত্বাধিকারী খান মাহবুব মেলায় খুব একটা আসেন না। ম্যানেজার আর বিক্রয় কর্মীরাই তার দুই ইউনিট বিশিষ্ট স্টল সামলান। প্রচণ্ড ভিড় সামলাতে ম্যানেজার এবং বিক্রয় কর্মীরা হিমশিম খেতে পারেন— এমন চিন্তা থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে মেলায় আসেন তিনি। কিন্তু বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা মেলেনি পলল প্রকাশনীতে!
সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় পলল প্রকাশনীর স্টলে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে চেয়ার পেতে বসে আছেন খান মাহবুব। একজন বিক্রয়কর্মী কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলছেন। বইমেলা লোকে ভরপুর। কিন্তু পলল প্রকাশনীর আট ফুট বাই চব্বিশ ফুট আয়তনের স্টল ‘বিরানভূমি’।
বেচা-বিক্রি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বিক্রয়কর্মী দেখিয়ে দিলেন পলল প্রকাশনীর মালিক খান মাহবুবকে। আর খান মাহবুব দেখিয়ে দিলেন বিক্রয় কর্মীকে। এমন পরিস্থিতিতে বুঝতে আর বাকি রইল না, বেচা-বিক্রি নিয়ে ‘তাহাদের মন ভালো নেই।’
মন আসলে সবারই খারাপ! বেশ কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের বিক্রি খুব একটা ভালো না। গতবার কোভিড পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো ছিল না। তারপরও বই বিক্রি ভালো ছিল। এবার সার্বিক পরিস্থিতি ভালো। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও নেই। সুতরাং সবাই ভেবেছিল বইমেলার প্রত্যেকটা স্টল-প্যাভিলিয়নে খুব ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু বই বিক্রি আশানুরূপ হয়নি।
অন্যান্য বছর একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে অনেক লোকের সমাগম হয়, অনেক পাঠক আসে। কিন্তু এ বছর সকালবেলা ছিল ফাঁকা। দুপুরের পরে অনেক দর্শনার্থী বইমেলা ঢুকেছে। কিন্তু ওই অনুপাতে বই বিক্রি হয়নি। অনেক লোক, অনেক ভিড়। কিন্তু বই বিক্রি কম।’
বইমেলার বিশেষ বিশেষ দিনে ফটো রোগে আক্রান্তদের যন্ত্রণায় প্রকাশনী সংস্থার কর্তাব্যক্তি এবং কর্মীদের সঙ্গে কথা বলা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা গাঢ় হলে প্যাভিলিয়নের সামনে থেকে যখন এরা সরে যায়, তখন প্রকাশক এবং তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ইউনিভার্সিটি প্রেস লি: -এর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয়। ২১ শে’র দিন বই বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কমপারেটিভলি চিন্তা করলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের বিক্রি খুব একটা ভালো না। কম বিক্রির কারণটাও বুঝতে পারছি না। দেশে একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। প্রত্যেকটা দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে। মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান— এগুলোই কিন্তু আগে। বই একদম প্রথম সারির প্রডাক্ট না যে, আমাকে এগুলো কিনতেই হবে। আমার কাছে মনে হয়, এই সমস্যার কারণে এবার বই বিক্রি কম হচ্ছে।’
প্রথমা প্রকাশনীর ম্যানেজার জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোটের ওপর আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আজ অনেক লোক বইমেলায় এসেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে বই বিক্রি হয়নি। ওভার অল বই বিক্রি গত বছরের তুলনায় কম।’
এর পেছনে কারণ কী থাকতে পারে?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই। সেই সঙ্গে হঠাৎ করে কাগজের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের প্রডাকশন কস্ট বেড়ে গেছে। বর্ধিত মূল্যে বই কেনার সামর্থ অনেকেরই নেই।’
বইমেলার প্রবেশ দ্বার বন্ধ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে টিএসসি সংলগ্ন গেটে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ লোক খালি হাতে বাসায় ফিরছে। ঘুরে ফিরে আড্ডা মেরে দিনটা দারুণভাবে উপভোগ করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। বইমেলায় আসা ৯০/৯৫ শতাংশ লোকই বই না কেনার দলে।
বেশিরভাগ লোক বইমেলা থেকে খালি হাতে বের হলেও ২১ শে ফেব্রুয়ারি নতুন বই এসেছে ৩০৩টি। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ ৯২টি, ভ্রমণ ৯টি, উপন্যাস ৩৪টি, ইতিহাস ৬টি, প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৬টি, রাজনীতি ২টি, কবিতা গ্রন্থ ৯৬টি, স্বাস্থ্য ৩টি, গবেষণা ১২টি, বঙ্গবন্ধু ৩টি, ছড়া গ্রন্থ ১২টি, ধর্মীয় ৬টি, জীবনী ৬টি, অনুবাদ ৪টি, শিশু সাহিত্য ৭টি, রচনাবলি ৪টি, অভিধান ১টি, মুক্তিযুদ্ধ ৭টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি, নাটক ৫টি, বিজ্ঞান ৪টি এবং অন্যান্য ২১টি গ্রন্থ।
মূলমঞ্চ ও বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠান
মহান শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাত সাড়ে ১২ টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
সকাল ৮ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। স্বরোচিত কবিতাপাঠে প্রায় ১৫০ জন কবি কবিতা আবৃত্তি করেন। সভাপতিত্ব করেন কবি জাহিদুল হক।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা। এতে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান। অমর একুশে বক্তৃতার বক্তা ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। বিদেশ সফরজনিত অনুপস্থিতিতে তার লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন ত্রপা মজুমদার। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
স্বাগত ভাষণে এ. এইচ. এম. লোকমান বলেন, ‘বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি আন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথ রঞ্জিত করেছে, প্রতিষ্ঠা করেছে আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়, যা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত করে।’
বক্তারা বলেন, ‘আমরা সবাই স্বীকার করি, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয়তাবোধ শাণিত হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কেবল আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ছিল না। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলন। আজ স্বাধীন দেশের ভাষার অধিকার বলতে আমরা বুঝি সব মানুষের সার্বিক বিকাশের অধিকার। তাই সর্বস্তরে বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সব মানুষের জীবন বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রত্যাশা সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ ভেঙে তারা একটা উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যে দেশে পরমতসহিষ্ণুতা থাকবে, ভিন্নমত ও সংস্কৃতির প্রতি থাকবে শ্রদ্ধাবোধ।’
সভাপতির বক্তব্যে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আমাদের জীবনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ কোনো দিন নয়; জাতির জীবনে এ দিবসটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একুশ আমাদের চেতনাকে জাগ্রত রাখে। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের তরুণ সমাজকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মাসউদ আহমাদ, তানভীর সালেহীন ইমন, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এবং শামীম আজাদ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন সুজন বড়ুয়া, নভেরা হোসেন, রিমঝিম আহমেদ, মতিন রায়হান, নাজমুল হেলাল, সালমা বেগ, ইমরুল ইউসুফ, ইসমত শিল্পী, মায়াবী কাজল, গিয়াসউদ্দিন চাষা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রূপা চক্রবর্তী, আহ্কামউল্লাহ। ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, শিবু রায়, কল্যাণী ঘোষ, মহাদেব ঘোষ, আবদুল হালিম খান, স্বর্ণময়ী মণ্ডল এবং সোমা দাস। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), মো. মোস্তাফিজুর রহমান ডাবলু (কি-বোর্ড), আনসার আলী (বাঁশি) এবং মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড)।
আগামীকাল ৯ই ফাল্গুন, ২২ শে ফেব্রুয়ারি বুধবার অমর একুশে বইমেলার ২২তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা ও ছড়া এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত লোকায়ত সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মতিন রায়হান ও সুমনকুমার দাশ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন তারিক সুজাত, তপন বাগচী, মোস্তাক আহমাদ দীন এবং অনুপম হীরা মণ্ডল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কামাল চৌধুরী।
সারাবাংলা/এজেড/একে