ক্ল্যাসিক বইয়ের খোঁজে বইমেলায় বোদ্ধা পাঠক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:০১
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) প্যাভিলিয়নে দাঁড়িয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী সম্পাদিত ‘হিন্দু ‘জনগোষ্ঠীর একাত্তর’, ‘গ্রামের একাত্তর’ ও ‘নারীদের একাত্তর’ বই তিনটি উলটিয়ে-পাল্টিয়ে দেখছিলেন তরুণ গবেষক জেড. এ. মঈন। একই প্যাভিলিয়নের বিপরিত পাশে এক বিদেশি ভদ্রলোক এবং এক প্রবীণ বাঙালি মনোযোগ সহকারে ইউপিএল’র নতুন বইগুলো দেখছিলেন।
ধুলা-বালি-ভিড়হীন নিরিবিলি বিকেলে দীর্ঘ সময় নিয়ে খুঁটে খুঁটে বই বাছাই শেষে ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’, ‘গ্রামের একাত্তর’ ও ‘নারীদের একাত্তর’ বইসহ বেশ কিছু বই কিনলেন জেড. এ মঈন। বিদেশি ভদ্রলোকটিও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘Political Parties in India’ বইটি নিলেন। বইয়ের দামটা মিটিয়ে দিলেন তার বাঙালি বন্ধু সৈয়দ আবু খালেদ খসরু। তিনিও বেশ কয়েকটি বই নিলেন ইউপিএল থেকে।
জেড. এ মঈন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার যে ধরনের বই প্রয়োজন, সে ধরনের বই মেলার শুরুর দিকে খুব একটা পাওয়া যায় না। এ কারণেই শেষ দিকে বইমেলায় আসি। যেসব প্রকাশনী থেকে বই কিনি, তাদের সঙ্গে ওভার টেলিফোনে যোগাযোগ রাখি। তাদের পক্ষ থেকেও শেষের দিকে বইমেলায় আসার পরামর্শ থাকে।’
ধানমন্ডি থেকে বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে বইমেলায় আসা সৈয়দ আবু খালেদ খসরু সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিলাম। সেই সুবাদে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের একজন পিটার জুভেন্টা ডেউস। ও কিছু দিন আগে বাংলদেশে এসেছে। আজ নিরিবিলি দিন পেয়ে ওকে বইমেলায় নিয়ে এলাম। ইউপিএল থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি বইও কিনে দিলাম।’
ইউপিএল’র অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউপিএল বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশনী সংস্থা, যারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বই প্রকাশ করে। আমাদের এখান থেকে প্রাকাশিত ৪০ শতাংশ বই ইংরেজি ভাষার। ইউপিএল থেকে প্রচুর বই বিদেশে রফতানি হয়। আবার মেলার শেষের দিকে দেশি ‘বোদ্ধা’ পাঠকের পাশাপাশি বিদেশি পাঠকও আমাদের এখানে বই কিনতে আসে।’
কথা বলার মাঝখানেই গোপীবাগ থেকে মেলায় আসা সিদ্দিকুর রহমান ইউপিএল ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলেন, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের ‘Political Parties in India’ বইয়ের বাংলা সংস্করণ এসেছে কিনা। জবাবে তিনি (এ কে এম কামরুজ্জামান) বললেন, ‘এবারও সম্ভব হচ্ছে না। ইউপিএল যেহেতু বইয়ের মানের ব্যাপারে সিরিয়াস, সেহেতু গুরুত্বপূর্ণ এ বইটির বাংলা সংস্করণ আসতে আরও কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।’
শুধু ইউপিএল নয়, ক্লাসিক বইয়ের প্রকাশনীগুলোর প্যাভিলিয়ন স্টলে ছুটি ও বিশেষ দিনের মতোই ভিড় দেখা গেল। পুরো বইমেলায় লোক কম থাকলেও ঐতিহ্য, প্রথমা, মাওলা ব্রাদার্স, অন্যপ্রকাশ, অন্যধারা, পুঁথিনিলয়, পাঠক সমাবেশ, কথা প্রকাশ ও জার্নিম্যান বুকস প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে যেসব লোক ভিড় করছেন, তাদের প্রায় সবাই বইয়ের ক্রেতা। এদের বড় একটি অংশ অপেক্ষাকৃত প্রবীণ এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল।
মাওলা ব্রাদার্সের প্যাভিলিয়ন থেকে বই কিনছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর ফারহানা সুলতানা আইভি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হেড অফিসের লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে আসা ফারহানা সুলতানা আইভি বইমেলা ঘুরে ‘আফলাতুন হায়দার চৌধুরীর ‘সাগরের গল্প’, জাপানি লেখক হেক্টর গার্সি ও ফ্রানেস্ক মিরালসের ‘ইকিগাই’, নোবেল লরিয়েট কলাম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবারিন্থ’, রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত ‘পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র’সহ একগাদা বই কিনেছেন। বই বহন করার জন্য সঙ্গে একজন সহকারীও নিয়ে এসেছেন তিনি।
সারবাংলাকে আইভি বলেন, ‘হেড অফিসের লাইব্রেরির জন্য প্রতিবছরই বই কেনা হয়। গবেষণা, ক্যারিয়ার, বিজসেন, ইকোমিক— এই বইগুলো আমরা বেশি কিনি। সেইসঙ্গে কর্মীদের মন ও মনন বিকাশে সৃজনশীল ও মননশীল বইও কেনা হয়। আজ বইমেলার পরিবেশ অন্য দিনের থেকে শান্ত। সে কারণেই আজ এসেছি।’
বোদ্ধা শ্রেণির পাশাপাশি যারা ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন, তারাও বইমেলায় আসার জন্য একুশের পরের দিনটা বেছে নিয়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে বসন্তের বিকেলে বইমেলার নিরিবিলি পরিবেশে হৃদয়খুলে ঘুরে ফিরে সময় কাটাচ্ছেন। কিনছেন পছন্দের বইও।
রায়েরবাগ থেকে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বইমেলায় এসেছেন মো. লিটন ভূঁইয়া। বেশি কিছু বইও কিনেছেন তিনি। আরও কিছু বই কেনার ইচ্ছা থাকলেও খুঁজে পান লিটন ভূঁইয়া। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ড. মিজানুর রহমান আজহারীর বইটা খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। বাচ্চাদের জন্য বই কিনেছি। নিজের জন্য কয়েকটা ধর্মীয় বই কিনেছি। বই কেনা এবং ঘোরা-ফেরার জন্য আজকের পরিবেশটা অনেক সুন্দর।’
মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা ও ছড়া। এছাড়াও ছিল জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত লোকায়ত সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মতিন রায়হান ও সুমনকুমার দাশ। আলোচনায় অংশ নেন তপন বাগচী, মোস্তাক আহমাদ দীন এবং অনুপম হীরা মন্ডল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কামাল চৌধুরী।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দেশে ও বিদেশে অগণিত কবিতা ও ছড়া লেখা হয়েছে। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব যেমন কবিতা ও ছড়ার উপজীব্য হয়েছে, তেমনি এই মহান নেতার সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাও সংবেদনশীল কবি ও ছড়াকারদের ভীষণ মর্মাহত করেছে। ফলে রচিত হয়েছে অসংখ্য মর্মস্পর্শী কবিতা ও ছড়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত সংকট-অবিচারে কখনোই মনোবল হারাননি বরং দৃপ্ত পায়ে হেঁটেছেন কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য সাধক কবি বঙ্গবন্ধুর বীরত্ব নিয়ে লোকসংগীত, পুঁথি, জারি, ভাটকবিতা ও যাত্রাপালাসহ লোকায়ত ধারার নানা পর্যায়ের সাহিত্য রচনা করেছেন।
আলোচকরা বলেন, জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত অসংখ্য কবিতা ও ছড়ায় মিশে আছে এ মহান, দেশপ্রেমিক নেতার প্রতি কবি ও ছড়াকারদের আবেগ ও শ্রদ্ধা। এসব ছড়া ও কবিতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পত্রপত্রিকার পাতায় ও নিবেদিত ছড়া সংকলনগুলোতে। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় যেমন তাকে নিয়ে অনেক লোকসাহিত্য রচিত হয়েছে, তেমনি জন্মশতবর্ষেও রচিত হয়েছে পালাগান, ধুয়া গান এবং যাত্রাপালা। বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত এসব লোকসাহিত্য গন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এসব লোকসাহিত্য, ছড়া ও কবিতা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
সভাপতির বক্তব্যে কামাল চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীতে বহু মহান নেতা এসেছেন যারা নিজেদের জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যত কবিতা, ছড়া বা লোকসাহিত্য রচিত হয়েছে, তা আর কোনো নেতাকে নিয়ে হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন আমাদের মনে জাগতেই পারে। বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা যাকে নিয়ে ভবিষ্যতেও অসংখ্য সাহিত্য রচিত হবে এবং তার অসামান্য কীর্তি আমাদের সামনে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রফিকুর রশীদ, আহমাদ মাযহার, অদ্বৈত মারুত এবং মামুন খান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কামাল চৌধুরী, মুহাম্মদ সামাদ, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, আহমেদ জসিম, নাজমা আহমেদ, আ র ম বাকীবিল্লাহ, চঞ্চল আখতার, নাজমুল হুসাইন, আরেফিন রব। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী রোমানা আহমেদ সোমা, মাসুদুজ্জামান, আন্জুমান আরা, রশিদ কামাল।
এছাড়া ছিল মাসুম হুসাইনের পরিচালনায় নৃত্য ‘পরম্পরা নৃত্যালয়’, কোহিনূর রহমান শিল্পীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আনন্দ নিকেতন সংগীতালয়’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মোস্তাফিজুর রহমান, সালমা মোস্তাফিজ, ফারুক নূরী, এ টি এম গোলাম মোস্তফা, আমিরুল ইসলাম, মজিবুর রহমান বিরহী, রীতা ভাঁদুরী, আমর হাওলাদার বাবুল। নৃত্য পরিবেশন করবেন সাকিবুল ইসলাম। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন তুলসী সাহা (তবলা), শাহীনুর রহমান (কি-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি) এবং অরূপ কুমার শীল (দোতারা)।
আগামীকাল ১০ ফাল্গুন, ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার, অমর একুশে বইমেলা ২৩তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কথাসাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণা ও মুক্তগদ্য চর্চা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মিল্টন বিশ্বাস এবং ফরিদ কবির। আলোচনায় অংশ নেবেন গোলাম কুদ্দুছ, রফিকুর রশীদ, সুভাষ সিংহ রায়, সরিফা সালোয়া ডিনা, আলফ্রেড খোকন, মাসুদ পথিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম