Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বইমেলায় গল্প-আড্ডা-বিতর্কে রয়ালিটি প্রসঙ্গ

আসাদ জামান
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৪

বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে পাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কবি মুন রহমান এবং প্রকাশক আবিদ এ আজাদ তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত। এ ঝগড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো না। আবার এ ঝগড়ার গুরুত্ব রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে কমও না।

কবি মুন রহমানের বক্তব্য হলো- দেশের প্রথম সারির প্রকাশকরাও প্রতি বছর বইমেলা শেষে হতাশের ঝাঁপি খুলে বসেন। তাদের আকাঙ্ক্ষার গোডাউন থেকে হতাশা ছাড়া আর কিছু বের হয় না। তারা প্রতি বছরই বলেন— বই বিক্রি আশানুরুপ হয়নি। গত বছরে চেয়ে এ বছরের বই বিক্রি তুলনামূলকভাবে কম। এবারও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বই বিক্রি করতে পারেন নি। এখন আমার কথা হচ্ছে— তারা এ ব্যবসা ছেড়ে দেয় না কেন?

বিজ্ঞাপন


একদিকে বলবে বইয়ের ব্যবসা নেই। অন্যদিকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বিমানে চড়ে মালয়েশিয়া চলে যান। বছরের দুই/তিন বার আমেরিকায় না গেলে নিজেদের জাত থাকে না।

প্রকাশক আবিদ এ আজাদ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘যারা শান-সৈকতে থাকেন, তাদের কি কেবল প্রকশনার ব্যবসা? তাদের তো আরও ব্যবসা থাকতে পারে। বইয়ের ব্যবসায় লস হলেও অন্য ব্যবসায় হয়তো লাভ করে। সুতরাং বই বিক্রি নিয়ে প্রকাশকদের বক্তব্য একেবারে অযৌক্তিক না।’

কবি মুন রহমান ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নন। পাল্টা জবাব যেন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন তিনি— এসব ফালতু কথা রাখুন। লেখকদের ঠকানোর জন্যই প্রকাশকেরা এসব ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়। প্রকাশকেরা যদি অন্য ব্যবসা দিয়ে রুটি-রুজির জোগাড় করে, তাহলে ‘প্রকাশক’-এর সইনবোর্ড ব্যবহার করে কেন? গত ২০ বছরে ক’টা প্রকাশনী বন্ধ হয়েছে। আর নতুন করে কতগুলো প্রকাশনা সংস্থার জন্ম হয়েছে?

তর্ক যখন তুমুল আকাড় ধারণ করল, তখন প্রকাশক আবিদ এ আজাদ বাদামের টুপলা এগিয়ে দিয়ে বললেন, বাদাম খান, শান্ত হন। এরইমধ্যে কবি পিয়াস মজিদের আগমন। অদূরেই দাঁড়িয়ে লেখক এবং প্রকাশকের ঝগড়া থেকে মজা নিচ্ছিলেন এবারের বইমেলায় ছয়টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আসা প্রখ্যাত আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়।

বিজ্ঞাপন

কবিদের পাল্লা ভারি হয়ে যাওয়ায় প্রকাশক হার মেনে নিলেন। অন্যদিকে কবিরা তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞাত থেকে- কোন প্রকাশক লেখকের রয়ালিটি দেওয়ার ভয়ে বাংলা একাডেমি এবং মিডিয়াকে বই বিক্রির ভুল তথ্য দেয়, কোন প্রকাশক প্রকাশনা ব্যবসার আড়ালে আরও নানা রকম ধান্দা-ফিকির করে, সেগুলোর ফিরিস্তি দিতে লাগলেন।

বইমেলায় বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করলে প্রতি বছরই লেখক-প্রকাশকদের হিসাব-নিকাশ মেলানোর সময় এলে এ রকম গল্প-আড্ডা-বিতর্ক চলতে দেখা যায়। তাতে এই দুই শ্রেণির মধ্যে তেমন কোনো দূরত্ব তৈরি হয় না। বরং এই ঝগড়া-বিবাদের মধ্য দিয়ে লেখকরা লেখা-লেখির নতুন প্লট খুঁজে পান। আর প্রকাশকেরা পান বই প্রকাশের জন্য নতুন নতুন পান্ডুলিপি।

বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা প্রকাশনীর কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে লেখকদের রয়ালিটি দেওয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। অধিকাংশ তরুণ লেখক রয়ালিটি চুক্তি ছাড়াই তাদের পান্ডুলিপি প্রকাশকদের হাতে তুলে দেন। বই ভালো চললে মোটামুটি ১৫ রয়ালিটি পান। আর না চললে বই ছাপার খরচটাও ক্ষেত্র বিশেষ লেখককে বহন করতে হয়। নতুন লেখকদের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ লেখক পকেটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করে থাকেন।

 

আবার এর উল্ট চিত্রও আছে। প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক অগ্রিম টাকা নিয়ে প্রকাশককে বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিতেন, কবি আল মাহমুদ এক পাণ্ডুলিপির জন্য দুইজন প্রকাশকের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছেন— এমন দৃষ্টান্তও আছে। হালের জনপ্রিয় লেখক মহিউদ্দিন আহমদকে বইলেখার জন্য নিজেদের টাকা খরচ করে মার্কিন মুল্লুকে পাঠিয়েছে প্রথমা প্রকাশন। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড লেখকদের রয়ালিটির টাকা পরিশোধ করে নতুন অর্থ বছরের শুরুতেই।

এ প্রসঙ্গে প্রথমা প্রকশনীর ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন সারবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর আমরা লেখকদের রয়ালিটি দিয়েছি ৭০ লাখ টাকা। প্রয়াত আবুল কালাম মোহম্মদ যাকারিয়ার বইগুলো পুনঃমুদ্রণের জন্য তার সন্তানদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। সেখানে রয়ালিটির বিষয়টি আইনানুগ পদ্ধতিতে ফিক্সড করা হয়েছে। আমরা লেখকদের রয়ালিটি দিয়েই বই প্রকাশ করি।’

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এ এক এম জাকারিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘রয়ালিটি ছাড়া কারও বই প্রকাশ করা যায়, এমনটি আমরা কখনো ভাবিনি। আমরা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন মানের দিকটা আগে দেখি, ঠিক তেমনিভাবে লেখকদের রয়ালিটির বিষয়টিও সর্বাধিক গুরুত্ব দেই। প্রত বছর জুনে লেখকদের সমুদয় রয়ালিটি আমরা বুঝিয়ে দিই।’

তবে বড় বড় প্রকাশনী রয়ালিটির ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেও অপেক্ষাকৃত ছোট এবং নতুন প্রকাশনীগুলো লেখকদের রয়ালিটি দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না। বরং লেখককে দিয়ে বই বিক্রির কাজটিও করিয়ে নেন তারা। বইমেলায় ১০টা বই বের করলে তার মধ্যে অন্তত পাঁচটি বই থাকে নতুন লেখকদের। এই নতুন লেখকদের কাছ থেকে হয় অগ্রিম টাকা গ্রহণ, না হয় বই বিক্রি করে দেওয়ার শর্তে পাণ্ডুলিপি হাতে নেয় ছোট প্রকাশনীগুলো।

এ ব্যাপারে ‘পড়ুয়া’ প্রকাশনীর প্রকাশক কবীর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বই প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা যে পুঁজি বিনিয়োগ করি, সেটিই তো ফিরে আসে না। লেখকদের রয়ালিটি কী দেব? তবে হ্যাঁ, এ কথাটা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, কোনো লেখকের বই প্রকাশ করে যদি লাভের মুখ দেখি, তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের রয়ালিটি দেই। এটা নিয়ে কোনো ছল-চাতুরি আমরা করি না।’

সারাবাংলা/এজেড/একে

আড্ডা একুশে বইমেলা গল্প প্রকাশনী বইমেলা ২০২৩ রয়্যালিটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর