Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবি ও কবিতার বইমেলা

আসাদ জামান
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৪৫

বইমেলার গৌরব প্রকাশনীর স্টলে দাঁড়িয়ে পাঠকদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন কবি অনিমেষ দাস। এবার মেলায় আসা তার ‘মন’ কাব্যগ্রন্থটি ভালো সাড়া ফেলেছে। ‘কাগজে কলমে দু’জনেই সজাগ/ভাবনা বেচারা বিভোর ঘুমে/শব্দের মনে বেজায় রাগ/অক্ষর কাঁদশে দুঃখের চুমে’ (দুঃখ) অথবা ‘শিথানে আমার অনন্ত প্রেম/পৈথানে কলঙ্ক দেহ/প্রেমে তুমি সোনা ফলাও/ দেহে ঝরাও মোহ’ (দেহ)— এ রকম অসংখ্য অনু কবিতায় সাজানো ‘মন’ কাব্যগ্রন্থ কেনার জন্য কবির বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন-আত্মীস্বজন এসে ভিড় জমিয়েছে গৌরব প্রকাশনীর স্টলে।

পেপার ব্যাক বাঁধায়ে পকেট সংস্করণ মন কাব্যগ্রন্থটির গায়ের মূল্য ৭০ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। কবি উপস্থিত থেকে পরিচিতজনদের হাতে কাব্যগ্রন্থটি তুলে দিচ্ছেন— এরকম নানাবিধ কারণে কবিতার বইটি ভালো যাচ্ছে এমনটিই ইঙ্গিত দিলেন গৌরব প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী মো. জহির উদ্দীন। তার দেওয়া তথ্য মতে, ‘মন’ ছাড়াও অনিমেষ দাসের আরও দুইটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না। অন্য কবিদের আরও সাতটি কাব্যগ্রন্থ বের করেছে গৌরব। সেগুলোও কেউ কিনছে না।

কবিতার বই বিক্রি না হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় কবি অনিমেষ দাসের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কবিতা হচ্ছে সাহিত্য জগতে চরম অধ্যায়ের নাম। ইচ্ছা করলেই কবিতা লেখা যায় না। কবিতার নামে যা লেখা হয়, তা সব সময় কবিতা হয়ে ওঠে না। আবার চিন্তাশীল পাঠক ছাড়া সাধারণ পাঠক কবিতা বুঝতে পারে না। এসব কারণে কবিতার বই কম বিক্রি হয়।’

ছোট্ট প্রকাশনী ‘অস্তিত্ব’ সর্বসাকুল্যে বইমেলায় নতুন বই এনেছে ৫টি। এর মধ্যে কবিতার বই রয়েছে একটি। কবি রতীশ মজুমদার উজ্জ্বলের ‘অশ্রু নদীর সবুজপাড়ে’ কাব্যগ্রন্থটির একটি কপিও বিক্রি হয়নি বলে জানান ‘অস্তিত্ব’র বিক্রয়কর্মী রমা বর্মণ।

কবিতার বই বিক্রি হয় না জেনেও কেন কাব্যগ্রন্থ বের করেন?— এমন প্রশ্নের জবাবে ‘অস্তিত্ব’ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জাহিদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যদি নতুনদের সুযোগ না দেই, তাহলে নতুন লেখক তৈরি হবে না। আজ ওদের বই বিক্রি হচ্ছে না, কাল হবে।’

পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এবারের বইমেলায় কবিতার বই এনেছে ১০টি। সেগুলোর মধ্যে হোসনে আরা ডলির ‘জিয়নকাঠী’, ‘বিহঙ্গীর অধরে বিকেল বিলাস’, ‘কবিতার জলরঙ’, `প্রান্তরে পথিক’, শেলী ফেরদৌসের ‘নিঃশব্দের পলঙ্কে’, তাইজুল ফয়েজের ‘নিশি রাতে চাঁদের সাথে’, সেনুয়ারা আক্তার চিনুর ‘অমীমাংসিত হৃদয় কথন’, গুলশান আরা রুবির, ‘Window of Lovely Night’ উল্লেখযোগ্য।

তবে উল্লেখযোগ্য এসব কবিতাগ্রন্থের কোনোটিই তেমন বিক্রি হয়নি। কোনো কাব্যগ্রন্থের দুই/চার কবি বিক্রি হয়েছে এমন খবরও দিতে পারলেন না ‘পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী বায়েজিদ মাহমুদ ফয়সাল। তারপরও কেন কবিতার বই বের করেন?— কবিতা তো সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ধারা। পৃথিবীর বড় বড় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কপি উঁইপোকায় খেয়েছে। সুতরাং বিক্রি নিয়ে চিন্তা করলে এ দেশে আর কেউ কবিতা লিখবে না। সাহিত্যের সেবক হিসেবেই আমরা নতুন কবিদের কবিতার বই বের করি।’

তবে কবিতার বই নিয়ে নতুন গল্প শোনালেন কাগজ প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী মো. ইব্রাহীম। তাদের ছয়টি নতুন বইয়ের মধ্যে তিনটিই কাব্যগ্রন্থ এবং এই কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিরাও নতুন। এগুলো তাদের প্রথম বই। তারপরও ‘মোটামুটি’ বিক্রি হয়েছে।

এই ‘মোটামুটি’ বিক্রি হওয়ার রহস্য সম্পর্কে মো. ইব্রাহীম বলেন, মারুফা মিতার ‘বোতাম ঘর’, দিপন দেবনাথের ‘আদি ফসিলের গান’ এবং সাকিব মাহমুদের ‘ঘুমিয়ে থাকা বাড়ি’— এ তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই ‘জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার’ পেয়েছে। অর্থাৎ এসব কাব্যগ্রন্থ’র পাণ্ডলিপি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাছাই করা হয়েছে। সুতরাং এদের লেখা কবিতা মানে উত্তীর্ণ।

এভাবে পুরো মেলাজুড়ে ৪৮৯ স্টল এবং ৩৪টি প্যাভিলিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য তরুণ ও নবীন কবির শত শত কাব্যগ্রন্থ। বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্যমতে এখন পর্যন্ত বইমেলায় নতুন বই এসেছ ২৯৬৫টি। এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক রয়েছে কবিতার বই। এখন পর্যন্ত কবিতার বই এসছে ৯২৫টি। প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবাই যেহেতু বাংলা একাডেমিতে নতুন বই জমা দেয় না, সেহেতু নতুন বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

কবি এবং কবিতার এই বইমেলায় দাঁড়িয়ে কেন যেন বারবার হৃদস্পন্দে ধ্বনিত হচ্ছিল- ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা/কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা/যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে/যে কবিতা শুনতে জানে না/সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে/ যে কবিতা শুনতে জানে না/সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে/আমি উচ্চারিত সত্যের মতো/স্বপ্নের কথা বলছি/…আমি কিংবদন্তির কথা বলছি।’

মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান

শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশু প্রহর। সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।

শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার ক-শাখায় ওয়াকিয়া নূর (প্রথম), আফফান আল হাসনাইন (দ্বিতীয়), রুজাইনাহ মারিফা (তৃতীয়)। খ-শাখায় প্রত্যয় পাল রাজ (প্রথম), তাসনিয়াহ সিদ্দিক (দ্বিতীয়), শাফিন উদ্দিন আহম্মেদ (তৃতীয়)। গ-শাখায় অর্নিলা ভৌমিক (প্রথম) আল মুমিনুর (দ্বিতীয়), জায়ীফা তাসনীম (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।

শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ক-শাখায় আরোহী বর্ণমালা (প্রথম), অংকিতা সাহা রুদ্র ((দ্বিতীয়) এবং জুমানা হোসেন (তৃতীয়)। খ-শাখায় সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ (প্রথম), আনিশা আমিন (দ্বিতীয়) এবং অদ্রিতা ভদ্র (তৃতীয়) এবং গ-শাখায় আদিবা সুলতানা (প্রথম), তাজকিয়া তাহরীম শাশা (দ্বিতীয়) এবং সিমরিন শাহিন রূপকথা (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।

শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার ক-শাখায় নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির (প্রথম), অন্বেষা মজুমদার (দ্বিতীয়) এবং সার্থক সাহা (তৃতীয়)। খ-শাখায় রোদোসী নূর সিদ্দিকী (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (দ্বিতীয়) এবং মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।

বিকাল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী।

প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ্বে সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে রচিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। এর কারণ, তত্ত্ব সম্পর্কে পৃথিবীর সব প্রান্তেই লেখক, পাঠক ও সমালোচকদের রয়েছে অনিঃশেষ আগ্রহ। তত্ত্বচর্চার মধ্য দিয়েই আত্মপরিচয়ের বিনির্মাণ, লৈঙ্গিক পার্থক্যের অপসারণ, নিম্নবর্গের মানুষকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা চলছে। বৈশ্বিকভাবে আজ অবধি যত তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে তার মধ্যে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ খুবই শক্তিশালী প্রভাব বজায় রেখেছে।

সভাপতির বক্তব্যে রাশিদ আসকারী বলেন, একুশ শতকে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতা সৃষ্টি। এজন্য গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ এসব তত্ত্বকে বিদ্যায়তনিক সীমার বাইরে এনে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি বিষয়কেই তাত্ত্বিক চিন্তার আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করতে হবে।

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন আশরাফ জুয়েল, রণজিৎ সরকার, মেহেদী হাসান শোয়েব, কানিজ পারিজাত।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন রেজাউদ্দিন স্টালিন, নাজমুন নেসা পিয়ারি, রওশন ঝুনু, ফরিদা ইয়াসমিন সুমি, নাঈমা খানম, মাদুসুল হক, হাসান মাহমুদ, প্রত্যয় জসিম, মাহী ফ্লোরা, প্রসপারিনা সরকার এবং মনিরুজ্জামান রোহান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শাহ কামাল সবুজ, আজহারুল হক আজাদ, শিরিন সুলতানা, ফারজানা মালিক নিম্মী, অনিকেত রাজেশ। এছাড়া ছিল কাঙাল মজিবরের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কাঙ্গাল হরিনাথ সাংস্কৃতিক সংগঠন’, এ. কে. আজাদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আনন্দন’, শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সুর সুধা সংগীতায়ন’, সিদ্দিকুর রহমান পারভেজের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’, সুবর্না আফরিনের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কিংবদন্তী আবৃত্তি পরিষদ’-এর পরিবেশনা।

সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আবিদা রহমান সেতু, আফরোজা খান মিতা, মারুফ হোসেন, আশরাফ উদাস এবং অগ্নিতা সিকদার মুগ্ধ। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন জয় সিংহ রায় (তবলা), ডালিম কুমার বড়–য়া (কি-বোর্ড), বিপিন চন্দ্র রায় (বাঁশি) এবং রণজিৎ বৈরাগী (দোতারা)।

আগামীকাল ১২ই ফাল্গুন, ২৫শে ফেব্রুয়ারি শনিবার অমর একুশে বইমেলা ২৫তম দিন। মেলা চলবে সকাল ১১ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে।

বিকাল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কোভিড-১৯: ভাষার বৈশ্বিকতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য এবং কোভিড-১৯: সংস্কৃতির সংকট ও রূপান্তর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাকিম আরিফ এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন পারভেজ হোসেন, হামীম কামরুল হক, কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং আবুল হাসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রফিকউল্লাহ খান।

সারাবাংলা/এজেড/একে

বইমেলা ২০২৩


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কুষ্টিয়া থেকে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:২৮

সম্পর্কিত খবর