পরিচয়পত্র ছাড়া রেলের টিকিট নয়, ভ্রমণে তথ্য না মিললে জরিমানা
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৪৩
ঢাকা: প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলেছে বিশ্ব, বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশে যতদিন গড়াচ্ছে ততই সহজ হচ্ছে মানুষের সেবা পাওয়ার পদ্ধতি। এখন ঘরে বসেই মানুষ নিতে পারছে সরকারি বহু পরিষেবা। এবার সেখানে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা ও ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে অনলাইন-অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট সংগ্রহে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে রেলওয়ে। টিকিটিং পদ্ধতি আপগ্রেডের নতুন এই নিয়ম কার্যকর হচ্ছে ১ মার্চ। তবে সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে রয়েছে মত-দ্বিমত। রেলে ভ্রমণকারীদের কেউ কেউ এই নিয়মকে স্বাগত জানিয়েছেন, আবার কেউ বলছেন পদ্ধতি বেশ জটিল। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, প্রথম পর্যায়ে জটিল মনে হলেও এতে যাত্রীরা অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
গণপরিবহন ব্যবস্থায় সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবহন হিসেবে রেলকে বিবেচনা করা হয়। তাই দূরপাল্লার যেকোনো ভ্রমণে মানুষ রেলকেই বেছে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে শতভাগ যাত্রী সুবিধা দেওয়ার সক্ষমতা নেই রেলওয়ের। যে কারণে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাত্রীদের জন্য একরকম দুঃসাধ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক সময় টিকিট মেলে না। আর ইদ উৎসবের সময়গুলোতে রেলের টিকিট সংগ্রহ বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। ফলে মানুষ বিকল্প উপায়ে কালোবাজার থেকেও টিকিট সংগ্রহ করে থাকে। এতে নিয়ম মেনে চলা যাত্রীরা ভ্রমণ থেকে বঞ্চিত হোন।
এ সব বিষয় মাথায় রেখে মোট টিকিটের অর্ধেক অনলাইনে বিক্রি করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে সংগ্রহ করতে পারে। এবার সেই পদ্ধতিতে নতুনত্ব আনতে যাচ্ছে রেলওয়ে। ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে অনলাইন ও অফলাইনে উভয় ক্ষেত্রেই আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট সংগ্রহে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে তথ্য না মিললে বিনা টিকিটে যাতায়াত করেছে বলে ওই যাত্রীকে গণ্য করা হবে। এরপর তার গুনতে হবে জরিমানা। আর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ১ মার্চ থেকে।
নতুন নিয়মে যেভাবে টিকিট সংগ্রহ করা যাবে
নতুন নিয়মে শুধু অনলাইন নয়, কাউন্টার থেকেও ট্রেনের টিকিট কিনতে নিবন্ধন করতে হবে। খুলতে হবে অ্যাকাউন্ট। কাউন্টার, অনলাইন ও অ্যাপের মাধ্যমে তা করা যাবে। ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা যাত্রীরা সাধারণত মোবাইল ফোন থেকে এসএমএসের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। আগে থেকে যাদের রেলের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা আছে তাদের সাইন-ইন করে জন্ম নিবন্ধন সদন আপলোড করতে হবে। আর যাদের আগে থেকে নিবন্ধন নেই, একেবারেই নতুন- তাদের প্রথমে ওয়েবসাইট ভিজিট করে সাইন আপ করে জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোডের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।
পুরনো নিবন্ধনকারীদের ক্ষেত্রে
ধাপ-১: বর্তমান username এবং Password দিয়ে https://etiket,railway.gov.bd-এ প্রবেশ করে BR <space> NID নম্বর space ticket.railway.gov.bd তে অথবা rail sheba app এ সাইন-ইন করতে হবে।
ধাপ-২: NID নম্বর এবং জন্ম তারিখ লিখে verify বাটনে ক্লিক করতে হবে। এরপর NID নম্বর জন্ম তারিখ সঠিকভাবে প্রবেশ করালে যদি NID নম্বরটি পূর্বে ব্যবহার করা না হয়ে থাকে তাহলে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হবে।
নতুন নিবন্ধনকারীদের ক্ষেত্রে
https://eticket.railway.gov.bd ওয়েবসাইট অথবা rail sheba app এ সাইন আপ করতে হবে এবং সঠিক NID নম্বর জন্ম তারিখ verify পূর্বক অন্যান্য তথ্য দিয়ে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
অফলাইন নিবন্ধন
মোবাইল থেকে মেসেজ অপশনে গিয়ে BR <space> NID নম্বর <space> জন্ম তারিখ (সাল-মাস-দিন) লিখে পাঠাতে হবে ২৬৯৬৯ নম্বরে। ফিরতি এসএমএসে রেলওয়ে জানাবে নিবন্ধন সফল হয়েছে কি না। সফল হলে অ্যাকাউন্ট নম্বর জানাবে। এরপর ওই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে এনআইডি দেখিয়ে স্টেশনে কাউন্টার থেকে টিকিট কেনা যাবে।
বিদেশি নাগরিকরা পাসপোর্ট দিয়ে অ্যাকাউন্ট করতে পারবেন। একটি এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধনের বিপরীতে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। একটি নম্বর দিয়ে প্রতিদিন একবারই টিকিট কাটা যাবে। এছাড়া ভ্রমণের সময় যাত্রীকে এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের ছবি সম্বলিত নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে। আরও দরকার হবে তাদের ই-মেইল নম্বর। থাকতে হবে ইন্টারনেট সম্পর্কে ধারণা ও স্মার্টফোন পরিচালনার জ্ঞান।
মানতে হবে যেসব শর্ত
১. ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বাবা মায়ের নাম ও এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করা রেলের অ্যাকাউন্ট বা জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। এমন ক্ষেত্রে টিকিটের ওপরে মুদ্রিত নামেরর সঙ্গে যাত্রীর সম্পর্ক যাচাইয়ের জন্য ভ্রমণকালে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে হবে।
২. বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে তাদের পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে পাসপোর্টের ছবি আপলোড করার মাধ্যমে নিবন্ধন শেষ করতে পারবেন।
৩. সফলভাবে এনআইডি/পাসপোর্ট/জন্মনিবন্ধন যাচাইপূর্বক নিবন্ধন ছাড়া কোনো যাত্রী আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কিনতে পারবেন না।
৪. ভ্রমণকালে যাত্রীকে অবশ্যই নিজস্ব এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন সনদের ফটোকপি অথবা পাসপোর্টের ছবি সম্বলিত আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।
৫. পরিচয়পত্রের সঙ্গে টিকিটের ওপরে মুদ্রিত কপিতে যাত্রীর তথ্য না মিললে বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে অভিযুক্ত করা হবে এবং রেলের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৬. যাত্রীরা আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এনআইডি/ জন্ম নিবন্ধন বা পাসপোর্টেরর মাধ্যমে রেলওয়ের সিস্টেম থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন।
৭. দেশের বিভাগীয় শহরের রেলস্টেশন ও আন্তঃনগর ট্রেনের শুরুর স্টেশনগুলোতে সর্ব সাধারণের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার জন্য একটি হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হবে।
সাধারণ যাত্রীরা যা বলছেন
বাংলাদেশ রেলওয়ের এই উদ্যোগ এক শ্রেণির যাত্রীর কাছে ইতিবাচক হলেও কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এই পদ্ধতি ভীষণ জটিল। তারা বলছেন, এই পদ্ধতি চালু করা করা হলে, ট্রেন সকল শ্রেণির যাত্রীদের যাতায়াতের মাধ্যম থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের সিস্টেম এমনই হওয়া উচিত। ভারতের এমন অনেক প্রদেশ রয়েছে যেখানে শিক্ষার হার অনেক কম, অথচ মানুষ এমন পদ্ধতি মেনেই নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন। তবে এই পদ্ধতিটা আরেকটু সহজ করা যেত।’
ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা নাসিমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে বাড়ি হওয়ায় আমি নিয়মিত ট্রেনে যাতায়ত করি। যাতায়াতের জন্য এটি আরামদায়ক পরিবহন। সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। কারণ, কালোবাজারির কারণে অনেক সময় টিকিট পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এতে কালোবাজারি বন্ধ হতে পারে।’
কমলাপুর রেলস্টেশনের যাত্রী মোবারক হোসেন সারাবাংলা বলেন, ‘গাজীপুর থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসি ট্রেনে করে। নতুন নিয়মে চালু হলে তা মেনে চলা কঠিন হবে। কারণ আমি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি না। আবার ইন্টারনেট সম্পর্কেও ধারণা কম।’
এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেক সাধারণ যাত্রীও। তারা বলছেন, তাহলে কি কম শিক্ষিত কিংবা ইন্টারনেট না জানা মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না?
মন্ত্রণালয় যা বলছে
বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনের অর্ধেক টিকিট বিক্রি হয় অ্যাপ ও অনলাইনে। অনলাইনে এনআইডি ও ফোন নম্বর দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে টিকিট কাটার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এনআইডি সঠিক কি না যাচাইয়ের সুযোগ নেই। নতুন যে পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে রেলওয়ে সেখানে তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন টিকিট কালোবাজারি বন্ধে বেশকিছু নতুন উদ্যোগের কথা জানান। এর মধ্যে অন্যতম ছিল এই টিকিটিং পদ্ধতি।
যেখানে বলা হয়, ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’। অর্থাৎ নিজ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে ট্রেনে ভ্রমণ করতে হবে। অন্য কারও তথ্য ব্যবহার করে ভ্রমণ করলে বিনা টিকিটে যাতায়াত করেছেন বলে তাকে অভিযুক্ত করা হবে এবং জরিমানা গুনতে হবে।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নানা উদ্যোগের পরেও কালোবাজারি থামানো যাচ্ছিল না। কালোবাজারিদের কারণে অনলাইন কিংবা কাউন্টারে টিকিট পান না সাধারণ যাত্রীরা। পরে কালোবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনতে হয়। এতে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। নতুন এই পদ্ধতি চালুর ফলে কালোবাজারি বন্ধ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ভোগ কমিয়ে যাত্রীদের সুবিধা দিতেই এই পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।’ এতে যাত্রীদের রেলভ্রমণ সহজ হবে এবং রেলের আয় বাড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম