এবারও বিক্রির শীর্ষে বঙ্গবন্ধুর ৩ বই ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৫৮
বইমেলার ২৫তম দিন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ইউনিভার্সিটি প্রেস লি: (ইউপিএল)-এর প্যাভিলিয়নে গিয়ে জানতে চাওয়া হলো- এবারের বইমেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই কোনটি?— উত্তর দিতে বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না ইউপিএল’র অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামান। চোখ বন্ধ করে বলে দিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এর পরেই আছে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। এ তালিকায় বিভিন্ন লেখকের নাম আসবে। তবে সব মিলে যা বিক্রি হয়েছে, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অন্য দু’টি বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রকাশক বাংলা একাডেমি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ মিলিয়ে চারটি প্যাভিলিয়ন রয়েছে একাডেমির বই বিক্রির জন্য। কিন্তু কোনো প্যাভিলিয়ন থেকে বই বিক্রির ন্যুনতম তথ্য পাওয়া গেল না। একাডেমির ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভবনের নিচ তলায় পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়েও মিলল না কোনো তথ্য। সবার একই কথা- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা সহকারী মো. রফিকুল ইসলাম পরামর্শ দিলেন- বিক্রয় বিপণন ও পুনঃমুদ্রণ বিভাগের পরিচালক জিএম মিজানুর রহমানের কাছে যেতে।
অবশেষে জিএম মিজানুর রহমান জানালেন- এবারও বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুইটি বেশি বিক্রি হয়েছে। এর পরেই আছে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের আত্মজীবনী ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’ বইটি।
বই বিক্রির এই তথ্যটুকু সংগ্রহের জন্য ইউপিএল’র অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামান এবং বাংলা একাডেমির বিক্রয় বিপণন ও পুনঃমুদ্রণ বিভাগের পরিচালক জিএম মিজানুর রহমানের কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বইমেলার স্টল-প্যাভিলিয়নে নিমিয়ত ঢুঁ মারলেই সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বই কোনগুলো, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে কী পরিমাণ বিক্রি হলো, সেটি জানার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা না বলে উপায় নেই।
কিন্তু নারীর বয়স, পুরুষের বেতন আর প্রকাশকদের কাছ থেকে বই বিক্রির প্রকৃত তথ্য জানা হিমালয় পাড়ি দেওয়ার মতোই কঠিন। এই বাস্তবতার নিরিখেই ইউপিএল’র অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার বললেন, ‘বাংলা-ইংরেজি ভার্সন মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বের করেছি। এর একেকটি ক্যাটাগরি সর্বোচ্চ ১৬ সংস্করণ এবং সর্বনিম্ন ১২ সংস্করণ বের হয়েছে, যেটা বই বিক্রির ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমির বিক্রয় বিপণন ও পুনঃমুদ্রণ বিভাগের পরিচালক বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বই কত কপি বিক্রি হয়েছে এবং কততম সংস্করণ চলছে, সেটা জানতে হলে একটু সময় দিতে হবে। আপডেট তথ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।’
এবার মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য ক্যাটাগরির নতুন বই এসেছে কয়েকশ’। এর মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে ৬৬টি নতুন বই। বইমেলার স্টল-প্যাভিলিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর বইয়ের পরই মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বেশি বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত আফসান চৌধুরীর ‘গ্রামের একাত্তর’, ‘নারীদের একাত্তর’ ও ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বই তিনটি সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় উপরের দিকে আছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনীতির বই প্রচুর বিক্রি হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের পর সৃজনশীল ও চিরায়ত সাহিত্যের বইগুলোও প্রচুর বিক্রি হয়েছে বলে জানালেন বেশ কয়েকটি বড় প্রকাশনীর কর্তাব্যক্তিরা। আগামী প্রকাশনীর ম্যানেজার মাহমুদুল হাসান মামুন জানান, তাদের প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইয়ের মধ্যে এবার সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে সলিমুল্লাহ খানের ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’ এবং ‘উৎসর্গ: পরিবার প্রজাতি রাষ্ট্র’ বই দুইটি।
মাওলা ব্রাদার্সের শাহীন সিকদার জানান, আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘নিহত নক্ষত্র’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে ‘খোয়াবনামা’, বইগুলো বেশি বিক্রি হয়েছে। ভাষাচিত্রের ম্যানেজার সাকলাইন হামিম জানান, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘অল্প কথার গল্প গান’ এবং অপু হাসানের ‘চৌত্রিশ নং গগন বাবু লেন’ বই দুইটি সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
জার্নিম্যান বুকস্ প্রকাশনী থেকে বের হওয়া সুরাইয়া খানমের ‘গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতা’ এবং মুনতাসীর মামুনের ‘হারিয়ে যাওয়া ঢাকার খোঁজে’ বই দু’টি এবারের বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স’র সিনিয়র সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন এক্সিকিউটিভ ইলিয়াস আহমেদ জানান, তাদের প্রকাশনী থেকে বের হওয়া মঈনুল হাসানের ‘আয়না ভাঙার পর’ এবং আহির মৃত্তিকার (Aahir Mrittika) THE UNFORGIVING CITY AND I বই দু’টি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
তবে অবাক করা তথ্য দিয়েছেন বাংলানামা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কবীর আলমগীর এবং ঐতিহ্যের ম্যানেজার আমজাদ হোসেন খান কাজল। যে কবিতার বই প্রকাশকদের কাছে ‘বোঝা’ মনে, সেই কবিতার বই এবার তাদের প্রকাশনীতে সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় উঠে এসেছে।
ঐতিহ্যের ম্যানেজার জানান, কবি পিয়াস মজিদের কাব্যগ্রন্থ ‘ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি’ এবং বাংলানামার স্বত্বাধিকারী জানান, কবি প্রতীক মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘শূন্যের শহরে বায়োস্কোপ ভোর’ এবারের বইমেলায় তাদের প্রকাশনীতে সর্বার্ধিক বিক্রি হওয়ার বইয়ের তালিকায় রয়েছে।
এবারের বইমেলায় বাংলানামা এবং ঐতিহ্যের এই খবরটাই সবচেয়ে ইউনিক এবং আশা জাগানিয়া হিসেবে দেখছে কবিতা প্রেমীরা। অন্যদিকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে শুধু রাজনীতির কবি ছিলেন না, সাহিত্য স্রষ্টা হিসেবেও তার অবস্থান এ বঙ্গে জন্ম নেওয়া যে কোনো যুগস্রষ্টা সাহিত্যিকের চেয়ে মোটেই পিছিয়ে নেই, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে এবারের বইমেলায়।
মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কোভিড-১৯: ভাষার বৈশ্বিকতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য’ এবং ‘কোভিড-১৯: সংস্কৃতির সংকট ও রূপান্তর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হাকিম আরিফ এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। আলোচনায় অংশ নেন পারভেজ হোসেন, হামীম কামরুল হক, কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং আবুল হাসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রফিকউল্লাহ খান।
প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিস্তৃতিতে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এমনই এক অতিমারি রোগ যা মানুষের সৃজনশীলতাকে নানামাত্রায় স্পর্শ করেছে। এই অতিমারির কারণে বাংলা ভাষাসহ সারাবিশ্বের ভাষাসমূহে নতুন শব্দমালা ও পরিভাষার উদ্ভব ঘটেছে। পাশাপাশি কোভিডকালীন বন্দিসময়ে বাংলা সাহিত্যে কোভিডকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। অতিমারির সময়টিতে আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সংস্কার। ফলে ধীরে ধীরে সংস্কৃতিও রূপান্তরিত হয়েছে।
আলোচকরা বলেন, কোভিডকাল আমাদের জীবনে নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছে, আমাদের চিন্তায় এবং জীবনযাত্রায় এনেছে পরিবর্তন। এ সময় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের মতো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিও অতিক্রম করেছে সংকটময় মুহূর্ত। করোনা আমাদের মনে যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে তা থেকে সারাবিশ্বের সাহিত্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। সমকালীন বাস্তবতার ভাষ্যকার শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ তাদের সাহিত্যে করোনার নানামুখী অভিঘাতকে চিত্রিত করেছেন। করোনা ভয়াল অভিঘাতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও জীবন-সংস্কৃতি যেমন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলার নানা পথ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে রফিকউল্লাহ খান বলেন, ‘করোনার সংকটময় কালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ ও মুখোমুখি হয়েছে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির। সে সময় আমরা বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নানাভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশের মানুষ সাহসিকতার সঙ্গেই করোনা সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন সামসাদ সুলতানা খানম, হাসান রাউফুন, বীথি রহমান এবং মামুন সারওয়ার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন প্রদীপ মিত্র, সুহিতা সুলতানা, চঞ্চল শাহরিয়ার, আরিফ মঈনুদ্দিন, সামতান রহমান, হরষিত বালা, কানিজ পারিজাত, মনির ইউসুফ, ইমরান পরশ এবং মীর রেজাউল কবির। আবৃত্তি পরিবেশন করেন সুপ্রভা সেবতি, সাহিত্য ভঞ্জ চৌধুরী এবং রত্না সিন্হা। এছাড়া ছিল রাজেশ দাস’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উঠোন’, আলম আরা জুঁই’র পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কুষ্টিয়া আবৃত্তি পরিষদ’, সাজেদ ফাতেমী’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নকশীকাঁথা’, আরিফুজ্জামান চয়ন’র পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘উদ্ভাস নৃত্যকলা একাডেমী’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মুজিব পরদেশী, রুশিয়া খানম, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সমর বড়ুয়া, লুনা ফাতিমা, ডালিয়া সুলতানা, নাসিমা খন্দকার পাপিয়া এবং সোমা দাস। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন সঞ্জয় কুমার দাস (তবলা), উসায়েদ আহমেদ প্রতীক (কি-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি) এবং অরূপ কুমার শীল (দোতারা)।
আগামীকাল ১৩ ফাল্গুন, ২৬ ফেব্রুয়ারি রোববার অমর একুশে বইমেলার ২৬তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্থানীয় সাহিত্যের বৈভব ও জেলা সাহিত্যমেলা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সাইমন জাকারিয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মুন্সি আবু সাইফ, সাহেদ মন্তাজ এবং মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মুহম্মদ নূরুল হুদা।
সারাবাংলাা/এজেড/পিটিএম