Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেসব কারণে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বইমেলা

আসাদ জামান
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:৪২

‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩। বাংলা একাডেমি। মূল প্রবেশ গেট: শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির গেট।’–  বইমেলার প্রধান প্রবেশ পথে এভাবেই ‘কিছু বাংলা, Some English’ লিখে রেখেছে খোদ বাংলা একাডেমি। এতে প্রতিদিন বইমেলায় আসা হাজার হাজার ‘বাঙালি’ পাঠক ও দর্শনার্থীর কিছু যায় আসে না। লিখতে লিখতে যারা চুল পাকিয়েছেন, সেসব লেখকদেরও এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আর বই প্রকাশ করতে করতে যারা এলিট ক্লাবে ঢুকে পড়েছেন, তারাও বোধ করি বাংলা একাডেমির এই ‘মূল প্রবেশ গেট’ নিয়ে কিছু ভাবেন না।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু মাস জুড়ে ‘মূল প্রবেশ গেট’-এর প্রধান ফটক বন্ধ রেখে প্রতিদিন বইমেলায় আসা হাজার হাজার পাঠক ও সাধারণ দর্শনার্থীকে যে যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে, তাতে বোধ করি সবার অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে বইমেলা কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে সেই মন্ত্রই উচ্চারিত হয়েছে, যে মন্ত্র পাঠ করলে সাপের বিষ পানি হয়ে যায়। প্রতিদিন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সংকীর্ণ পকেট গেট দিয়ে মাথা নিচু করে বইমেলায় প্রবেশের সময় ক্ষুব্ধ লোকজন ক্ষোভাগ্নি মিশ্রিত যে ‘বাণী’ বর্ষণ করেছে, তা কেবল ‘প্রাগৌতিহাসিক’ গল্পের দুই প্রধান চরিত্র ভিখু এবং পাঁচির মুখে শোভা পায়।

বিজ্ঞাপন

বইমেলার ২৬তম দিন রোববার (২৬ ফেব্রায়ারি) সন্ধ্যায়ও ‘মূল প্রবেশ গেট’- এর প্রধান ফটক বন্ধ রেখে পকেট গেট দিয়ে লোক ঢোকানো হচ্ছিল। ছয় ফুট উচ্চতার জনৈক নাজমুল ইসলাম বইমেলা ঢুকতে গিয়ে পকেট গেটের স্টিলের ফ্রেমে প্রচণ্ড একটা গুতা খান। অতঃপর তার মুখ থেকে যেটা বের হল, সেটা ওই ‘প্রাগৌতিহাসিক’ গল্পের নায়ক ভিখুর মুখনিঃসৃত বাণীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

জানতে চাওয়া হলো- এত বড় আয়োজনের ‘মূল প্রবেশ গেট’-এর প্রধান ফটক বন্ধ কেন? পুলিশ সদস্যরা বললনে, ‘এটা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।’

হ্যাঁ, কর্তৃপক্ষ এবার এ রকম অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পাশের গেট বন্ধ রেখেছে। ফলে ওদিক দিয়ে যারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে পড়েছে, তাদের কালী মন্দিরের পেছনে ঝোঁপ-জঙ্গল পেরিয়ে, গাজাখোরদের এড়িয়ে, আধা কিলোমিটার ঘুরে বইমেলায় প্রবেশ করতে হয়েছে। যারা শিখা চিরন্তন দিয়ে স্বাধীনতা জাদুঘর হয়ে বইমেলায় প্রবেশের জন্য জলাধার পর্যন্ত এসেছেন, তাদের ফের চারুকলা গেট দিয়ে বেরিয়ে টিএসসি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে বইমেলায় ঢুকতে হয়েছে।

এসব দুর্ভোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সংলগ্ন গেট সপ্তাহের সাত দিন খোলা রাখার ব্যাপারে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) আমরা বার বার অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা নিরাপত্তার কথা বলে সপ্তাহে দুই দিনের বেশি খোলা রাখতে রাজি হয়নি।’

‘মূল প্রবেশ গেটের প্রধান ফটক বন্ধ রাখা দেখে আমরাও অবাক হয়েছি। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধান ফটক খুলে রাখলে লোকজনের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। সে কারণে তারা প্রধান ফটক বন্ধ রেখে পকেট গেট দিয়ে লোক ঢুকিয়েছে। নিরাপত্তার ইস্যুতে পুলিশ যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে আমাদের কিছু বলার থাকে না’— বলেন কে এম মুজাহিদুল ইসলাম।

টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের মূল গেট পর্যন্ত বেষ্টনী তৈরি করে চারুকলা গেট দিয়ে আসা লোকদের দুর্ভোগে ফেলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ওই অংশটুকু বেষ্টনী দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করতাম, তাহলে হকার ও স্ট্রিটফুড এসে জায়গাটা দখল নিত। তখন আপনারাই (সাংবাদিক) প্রশ্ন করতেন, এই জায়গার অবস্থা এমন হল কীভাবে?’

শুধু প্রবেশ পথের বিড়ম্বনা নয়, এবারের বইমেলার প্রবেশ পথগুলোর রূপবিন্যাস ও সাজসজ্জার দীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ২০২২ সালে করোনা অতিমারির মধ্যেও বইমেলার প্রবেশ পথ, গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চ, লেখক বলছি মঞ্চ, চত্বর বিন্যসে ব্যবহৃত ডিসপ্লেবোর্ডসহ অন্যান্য সাজসজ্জায় যে জৌলুশ চোখে পড়েছে, এবার তার ছিটে-ফোটাও ছিল না অমর একুশে বইমেলায়। এ নিয়ে পাঠক, সাধারণ দর্শনার্থী, লেখক, প্রকাশক, সাহিত্যিকদের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা লক্ষ্য করা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো বইমেলার কাঠামো তৈরি, গেট ও মঞ্চগুলোর অঙ্গসজ্জার দায়িত্ব ক্রস ওয়াক (Cross walk)’-কে দেওয়া হয়েছিল। তারাই এ দায়িত্ব পালন করেছে। কোথাও যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, সে ব্যাপারে তাদের প্রশ্ন করতে পারেন।’

ক্রস ওয়াকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মারুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২২ সালের বইমেলাকে বলা হয়ে থাকে `বাণিজ্য মেলা’। সেবার প্রচুর স্পন্সর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু, এ বছর আমরা কোনো স্পন্সর পাইনি। কেউ কোনো অনুদান দেয়নি। ফলে বইমেলার রূপবিন্যস বা অঙ্গসজ্জা গত বছরের মতো করতে পারিনি। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই এবারের বইমেলার চাকচিক্য বাড়ানো সম্ভব হয়নি।’

বইমেলার আরেকটি ত্রুটি পাঠক-লেখক এবং প্রকাশকদের মধ্যে বিরক্তি উৎপাদন করেছে। সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বইমেলা আয়োজনের পরও স্টল ও প্যাভিলিয়নের মাঝের জায়গাটা ছিল কনজাস্টেড (সংকীর্ণ)। ফলে বিশেষ দিনে বইমেলায় আসা লোকজনকে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। স্টল-প্যাভিলিয়নে কর্মরত ব্যক্তিদের ‘দমবন্ধ’ অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রথমা প্রকাশনের ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বইমেলার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে দুই ‘রো’ (সারি) -এর মাঝখানে অপর্যাপ্ত জায়গা। লোকজন একটু বাড়লেই দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। এমন একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হয়েছে।’

বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মেনে নিচ্ছি, আয়োজনে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু আমাদের দিক থেকে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আমরা চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করার জন্য। হয়তো সব পেরে উঠিনি।’

এতসব সমস্যার মধ্যেও বইমেলার ২৬তম দিন রোববার (২৬ ডিসেম্বর) বিপুল সংখ্যক লোক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঘুরে-ফিরে বই কিনে, গল্প করে, আড্ডা মেরে পুরো আয়োজনকে সফল সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে। এদিনও প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে। সন্ধ্যার পর বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অনেক মানুষের হাতে দেখা গেছে ব্যাগভর্তি বই।

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সাহিত্যের বৈভব ও জেলা সাহিত্যমেলা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইমন জাকারিয়া। আলোচনায় অংশ নেন মুন্সি আবু সাইফ, সাহেদ মন্তাজ এবং মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক ধারা-উপধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যের বাইরে জেলায় জেলায়। কিন্তু ঢাকার বাইরে চর্চিত সাহিত্যের সৃষ্টিশীল বৈভবকে পর্যবেক্ষণ ও সংকলন করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাংলাদেশে অতীতে কখনও গৃহীত হয়নি। স্থানীয় সাহিত্য স্রষ্টাদের সৃষ্টিকর্মকে মূল্যায়ন ছাড়া সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। এসব দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে নিয়েই বাংলা একাডেমি জেলা সাহিত্যমেলার রূপরেখা প্রণয়ন করে এবং তা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলের জেলা প্রশাসনকে পাঠায়।

আলোচকরা বলেন, সাহিত্য জনমানুষের কথা বলে। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে হবে। এজন্য জেলা সাহিত্যমেলা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। জেলা সাহিত্যমেলায় অংশ নিয়ে স্থানীয় লেখক, সাহিত্যিকরা নিজেদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে সাহিত্য উপকরণাদি সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জেলা সাহিত্যমেলার নিয়মিত আয়োজন দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাকে বেগবান করবে।

সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, আঞ্চলিকতাকে অবলম্বন করেই বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই স্থানীয় সাহিত্যকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে আয়োজিত জেলা সাহিত্যমেলা আমাদের সাহিত্যের দিগন্ত প্রসারিত করবে।

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন সোহেল আমিন বাবু, হরষিত বালা, আসাদুজ্জামান আসাদ, মাহফুজা অনন্যা এবং মোহাম্মদ আলমগীর আলম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন মালেক মাহমুদ, সালাউদ্দিন বাদল, শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক এবং আলমগীর আলম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ম. ম. জুয়েল, সাফিয়া খন্দকার রেখা, ফয়জুল আলম পাপ্পু, শামস মিঠু এবং ফারজানা ইসলাম। এছাড়া ছিল দিলরুবা খানম’র পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘শব্দনোঙর’, ফরিদা পারভীন’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অচিন পাখি’, অনিকেত আচার্য’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’, ড. শামীম মতিন চৌধুরী’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিউটিফুল মাইন্ড’র পরিবেশনাও ছিল।

সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া, ফেরদৌস আরা, জেরিন তাবাসসুম হক, নয়ন বাউল, দেলোয়ার হোসেন বয়াতি এবং আমজাদ দেওয়ান। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন কাজী ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), মো. আতিকুল ইসলাম (বাঁশি) শেখ জালালউদ্দিন (দোতারা) এবং মো. হাসান মিয়া (বাংলা ঢোল)।

আগামীকাল ১৪ ফাল্গুন, ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার অমর একুশে বইমেলার ২৭তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববাঙালির সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আলম খোরশেদ। আলোচনায় অংশ নেবেন এ. এফ. এম. হায়াতুল্লাহ, আ-আল মামুন, জসিম মল্লিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

বইমেলা ২০২৩

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর