বেসিস সফট এক্সপোতে ১২০ কোটি টাকার সম্ভাব্য অর্ডার
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৫৯
ঢাকা: দেশের তথ্য প্রযুক্তির খাতের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ১৭তম বেসিস সফটএক্সপো থেকে ১২০ কোটি টাকার সম্ভাব্য অর্ডার পাওয়া গেছে। মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে সম্ভাব্য এই লিড পেয়েছে। ইউরোপের বাজারে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রসারেরও আশ্বাস পাওয়া গেছে। ২০৩১ সাল নাগাদ আইসিটি খাতের রফতানি আয় ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব- এমন সম্ভাবনার কথাও উঠে এসেছে এই এক্সপোতে।
এছাড়া, সফটওয়্যার ডেভেলপার সম্মেলন, আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প ও প্রথমবারের মতো নারীদের ই-স্পোর্টসসহ চোখ ধাঁধাঁনো নানা আয়োজন ছিল এবারের এক্সপোতে। ১৮ টি সেমিনারে আইসিটি খাতের নানা সম্ভবনা ও প্রসারের কথাও উঠে আসে। চারদিনের ওই মেলায় প্রায় এক লাখ দর্শনার্থী অংশ নেন। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) আয়োজিত এবারের এক্সপোকে ‘মাইলফলক’ হিসাবে আখ্যা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রথমবারের মতো এবারের এই এক্সপো রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) অনুষ্ঠিত হয়। ‘ওয়েলকাম টু স্মার্টভার্স’ স্লোগানকে সামনে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে এই মেলা। মেলায় আসা যাওয়ার জন্যে ছিল শাটল বাস সার্ভিস। এবারের মেলায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্টল অংশ নেয়। প্রথমদিন দর্শনার্থী কম থাকলেও শেষদিকে মেলা প্রাঙ্গণ দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর ছিল। মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন স্টলের কর্মকর্তারাও তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।
এবারের এক্সপোতে অংশ নিয়েছিল রোবোলাইফ। প্রতিষ্ঠানটি হাত হারানো মানুষকে রোবটিক হাতের সেবা দেয়। অনেক সময় দুর্ঘটনায় মানুষ হাত হারিয়ে ফেলে। সেই জায়গায় রোবটিক হাত ব্যবহার করলে আগের মতোই সব কাজ করতে পারবে। রোবো লাইফের প্রতিষ্ঠাতা জয় বড়ুয়া লাবলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মেলায় তিন দিন অংশ নিয়েছিলাম। শুক্রবার খুব ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। আমাদের অর্ডারের তালিকায় এখনও হাজারের বেশি অর্ডার পেন্ডিং রয়েছে। মেলা থেকে আরও ১০ থেকে ১২ জন অর্ডার দিয়েছে, সেগুলো নতুন করে পেন্ডিং অর্ডারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে।’
মেলায় অংশ নেওয়া ড্রোন সার্ভিস দেওয়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান টিলার’র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মাগফুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক্সপো খুবই ভালো ছিল। আমরা অনেক রেসপন্স পেয়েছি। অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা আন্তরিক ছিলাম এবং দর্শনার্থীরাও ভালো রেসপন্স করেছে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, মেলায় ছিল নিত্য নতুন নানান প্রযুক্তি। সেইসব প্রযুক্তির পসরাই যেন বসেছিল এবারের বেসিস সফটএক্সপোতে। কী নেই! ড্রোন, রোবট, উদ্ভাবনের অপেক্ষায় থাকা নতুন সফটওয়্যার- যেন সব কিছুরই দেখা মিলেছে। গেমিং জোনে গেমাররা তাদের দাপুটে অবস্থানের জানান দেয়। আর একাধিক সেমিনার তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় উঠে আসে দেশের আইসিটি খাতের বর্তমান চিত্র। যেন সবমিলিয়ে সাফল্য ও সম্ভবনার জানান দেয় এবারের ১৭তম বেসিস সফটএক্সপো-২০২৩।
বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমন বড় ভেন্যুতে এক্সপো হওয়ায় দর্শনার্থী ও প্রতিষ্ঠানগুলো খুশি। এবার ২০৪টি এক্সিবিউটর মেলায় অংশ নেয়। এর আগে কখনও এত বেশি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নেয়নি।’
আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প অ্যান্ড জব ফেয়ার
মেলার শেষ দিনে চাকরিপ্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখর ছিল বেসিস সফট্ক্সপো। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি গ্রাজুয়েট ও আইটি প্রফেশনালরা এতে অংশ নেয়। শুরুতে তারা পছন্দের আইটি কোম্পানিতে রেজিস্ট্রেশন করেন। শেষে কোম্পানিগুলো চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে সাক্ষাৎকার নেয়। বেসিস সফটএক্সপোর অংশ হিসেবে এ মেলা আয়োজনে সহযোগিতা করেছে দেশের চাকরিবিষয়ক শীর্ষ ওয়েবসাইট বিডিজবস ডটকম। ৫০০টি পদের বিপরীতে আইটি প্রফেশনাল নিয়োগের লক্ষ্যে এ মেলায় আয়োজন। ১০২টি চাকরিদাতা আইটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। বিপরীতে পাঁচ হাজারের বেশি চাকরিপ্রতাশী এই চাকরি মেলায় অংশ নেন।
প্রথমবারের মতো নারীদের ই-স্পোর্টস
এক্সপো উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী ই-স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করে বেসিস। প্রথমবারের মতো পুরুষ গেমারদের পাশাপাশি নারী গেমারদের জন্য ছিল ই-স্পোর্টস। এতে বিজয়ী হয়েছে টিম সেলেস্টিয়ালস। এছাড়া দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে ওয়াসাবি সাইরেন এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করে টিম জেটস অফ। বিজয়ী দল হিসেবে তারা সর্বমোট এক লাখ টাকা পেয়েছে। ৫০ জন নারীর আটটি টিম ই-স্পোর্টসে অংশ নেয়। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ে তিনটি টিম ফাইনালে অংশ নেয়। ভ্যালোরেন্ট পিজি গেমে অংশ নেয় তারা। পাশাপাশি পুরুষদের প্রায় ৮০টি টিমের ৫০০ জন এই খেলায় অংশ নিয়েছে। ভ্যালোরেন্ট, সিএসগো, এমএলবিবি এবং ফিফা গেমে অংশ নেয় তারা। সিএসগো গেমে ই-স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ী হয়েছে টিম গ্রেড বাইবারস, আনার আপ হয়েছে ম্যান আই লাভ ফিশিং। ভ্যালোরেন্ট গেমে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম এক্সেজেলিস স্পোর্টস, রানারআপ হয়েছে টিম হেড হান্টার্স। অন্যান্য ক্যাটাগরি মিলিয়ে মোট ছয় লাখ টাকার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
সফটএক্সপোতে সফটওয়্যার ডেভেলপার সম্মেলন
প্রযুক্তি সেবার প্রাণ বলা হয় ডেভেলপারদের। তারা সেবাগুলোকে সচল রাখতে, উন্নত করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে কাজ করতে গেলে ভুল হবে এবং সেটা থেকে আরও শিক্ষা নিয়ে নিজেদের উন্নত করার পরামর্শ দেন খাতটির কর্মীরা। সফটক্সপোর তৃতীয় দিনে বিগ শো হিসেবে ডেভেলপার কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশের তরুণ সফটওয়্যার ডেভেলপারদের অনুপ্রাণিত করতে এবং তাদের কাজ করার সময় যেসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, সেগুলো নিয়ে সম্মেলনটিতে আলোচনা হয়। তরুণ ডেভেলপারদের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেন দেশের শীর্ষ নামিদামি সফটওয়্যার ডেভেলপারস প্রতিষ্ঠানের সফল প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার প্রফেশনালরা।
ইউরোপে আইটি খাতের বাজার সম্প্রসারণের আশ্বাস
ইউরোপে দেশের আইটি খাতের বাজার সম্প্রসারণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউরোপে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান চেইন অব কমার্সের অংশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশকে তাদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে ইউরোপের বাজার ধরতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও ইন্ডাস্ট্রির সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ‘২০২৫ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রফতানি আয় পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাম্বেসেডর চার্লস হোয়াইটলি এসব কথা বলেন।
ভালো মানের সফটওয়্যার তৈরিতে জোর স্পিকারের
সফটএক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ভালো মানের সফটওয়্যার তৈরি করার আহ্বান জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সফটওয়্যার নির্ভরশীলতা প্রতিদিন বেড়েই চলছে। জাতীয় সংসদে যত আলোচনা হয় তা সব সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি বেসিসের সদস্যরাই তৈরি করেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের ভালো মানের সফটওয়্যারও তৈরি করতে হবে।’
রাসেল টি’র থ্রি বাই থ্রি থিওরি
বেসিস সফটএক্সপোর সমাপনী অনুষ্ঠানে ‘নীতিগত সহায়তা পেলে বেসিসকে দাবায় রাখা যাবে না’ বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বেসিস সভাপতির ‘থ্রি বাই থ্রি থিওরির’ সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আর বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ তার ‘থ্রি বাই থ্রি’ পুনর্ব্যক্ত করেন।
থ্রি বাই থ্রি থিওরি সম্পর্কে বেসিস সভাপতি রাসেল টি বলেন, ‘২০২৫ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বেসিস বিশ্বাস করে, শুধু পাঁচ বিলিয়ন ডলার নয়, ২০৩১ সাল নাগাদ এই খাত থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা সম্ভব। সরকার, ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমিয়া এই তিনটি স্টেকহোল্ডার সমন্বিতভাবে তিনটি কাজ করলেই সেটি সম্ভব হবে। কাজগুলো হলো- তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গবেষণা ও উন্নয়ন, দেশে বিদেশে ইন্ডাস্ট্রি ব্র্যান্ডিং এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল তৈরি।’
সমাপনী অনুষ্ঠানে রাসেল টি আহমেদ এবারের বেসিস সফটএক্সপোর আয়োজনে সহায়তাকারী, অংশগ্রহণকারী, সহযোগী ও স্পন্সরদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘এক্সপোর চতুর্থ দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯২ হাজার দর্শনার্থী সফটএক্সপো ভ্রমণ করেছেন। এছাড়া অংশগ্রহণকারী ২০৪টি কোম্পানি ইতিমধ্যেই স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে প্রায় একশ বিশ কোটি টাকার সম্ভাব্য লিড পেয়েছে।’ ঢাকার বাইরে হলেও এটি একটি মাইলফলক বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম