পর্দা নামল বইমেলার, বিক্রি ৪৭ কোটি টাকা
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:৫৫
ঢাকা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়মুক্ত আয়োজনের মধ্য দিয়ে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার উনচল্লিশতম আসরের পর্দা নামল আজ। মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় স্টল-প্যাভিলিয়নের বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধের মধ্য দিয়ে এবারের আসরের সমাপ্তি টানা হয়।
এর আগে, বিকেল ৫টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। এতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অমর একুশে বইমেলার সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
বইমেলার সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বইমেলায় বাংলা একাডেমি-সহ সকল প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি এক কোটি ৩৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছিল। এবার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি এক কোটি ২৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। ২০২২ সমগ্র মেলায় ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এবার ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আজকের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে, এবার কমপক্ষে ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
আসলেই কী এ তথ্য সঠিক? বাংলা একাডেমি প্রতিনিধিরা স্টলে স্টলে বই বিক্রির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ফরম বিতরণ করেছেন। উল্লেখ্য অনেক স্টল/প্যাভিলিয়নের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। আবার ঐতিহ্য/আকার/প্রচারণায় এগিয়ে থাকা বেশকিছু স্টল/প্যাভিলিয়নের তথ্য-উপাত্ত বাস্তবসম্মত নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে এটি যে মেলার পূর্ণাঙ্গ বিক্রির হিসাব তা পরিচালনা কমিটি মনে করে না। কারণ, এর সাথে পরিসংখ্যানগত গবেষণার একটা বিষয় রয়েছে’— বলেন ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম
তিনি জানান, প্রবেশ পথে স্থাপন করা আর্চওয়ের পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলায় লোক ঢুকেছে ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন।
ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে একুশের সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সঙ্গে একাডেমির বই ৫০ শতাংশ কমিশনে বিক্রির যে উদ্বোধন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করেছিলেন, তা থেকেই পরবর্তীকালে অমর একুশে বইমেলার সূত্রপাত ঘটে। এইদিন বঙ্গবন্ধু প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে একাডেমিতে আসেন। তিনি ৫০ শতাংশ কমিশনে একাডেমির বই বিক্রি শুরু করে প্রকৃতপক্ষে অমর একুশে বইমেলার ভ্রূণের জন্ম দেন।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি, চিত্তরঞ্জন সাহা ও অন্যদের সহায়তায় বাংলা একাডেমি চত্বরে বইমেলার শুরু হয়েছিল। এখন এই বইমেলা কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাভাষী ও অন্য ভাষার মানুষও এই বইমেলার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই বইমেলা বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের স্থান, জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অহংকার।’
করোনা ভাইরাসের কারণে পর পর দুই বার ভার্চুয়ালি উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী এবার সশরীরে উপস্থিত হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৫ জন লেখকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এদিন বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও করেন তিনি। উল্লেখযোগ্য, বইগুলোর মাঝে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রচিত আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি এবং সেলিনা হোসেন ও মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত জেলা সাহিত্যমেলা ২০২২ (প্রথম খণ্ড)।
স্টল ও প্যাভিলিয়ন
এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমিসহ ৩৮টি প্রতিষ্ঠান উভয়প্রান্তে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। এবার এক ইউনিটের ৩২৮টি, দুই ইউনিটের ৩২২টি, তিন ইউনিটের ১৫৯টি এবং চার ইউনিটের ৯২টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য ৭১টি প্রতিষ্ঠান ১১১টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পায়।
শিশু কর্নার ও শিশু প্রহর
এবার মূল প্রবেশ গেটের ডানদিকে শিশু চত্বর রাখা হয়। এবারের বইমেলার শুরুর পূর্বেই প্রতি শুক্র ও শনিবার সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে শিশুসহ অভিভাবকরা আগে থেকেই এ বিষয়ে অবগত হয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত দিনে মেলায় আসার সুযোগ পেয়েছে। এবার কোভিড-১৯ এর বিরূপ পরিস্থিতি না থাকায় বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য আবৃত্তি, সংগীত ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল এবং বিজয়ীদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অন্যান্য বারের মতো এবারও শিশু চত্বরে সিসিমপুর আয়োজিত অনুষ্ঠানাদি শিশুরা মন ভরে উপভোগ করে।
লিটিল ম্যাগাজিন চত্বর
এবার লিটিল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের সামনে নেওয়া হয়। মোট ১৬০টি লিটল ম্যাগাজিনকে স্টল দেওয়া হয়। লিটলম্যাগ চত্বর এবার কেবল ভালো স্থানে, উন্মুক্ত পরিসরে হয়নি, এই চত্বরে প্রবেশের জন্য প্রসারিত ও খোলা পথ থাকায় বিশেষভাবে আকর্ষণীয়ও ছিল। এখানে দেশের তরুণ ও সম্ভাবনাময় সাহিত্যকর্মীরা তাদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন বিক্রয় এবং তাদের প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা প্রদর্শনের সুযোগ পান।
নীতিমালা অমান্য করায় কড়া সতর্কপত্র
এবার নীতিমালা অমান্য করে স্টলের কাঠামো বানানোর কারণে তিনটি প্যাভিলিয়নকে সতর্ক করে পত্র দেওয়া হয়। তারা নীতিমালার প্রতি সম্মান রেখে স্ব স্ব কাঠামো পুনর্বিন্যাস করেন। অন্যদিকে, সুস্পষ্ট কিছু নীতি ভঙ্গ করায় মেলা শুরুর প্রথম দিকে নয়টি এবং পরবর্তীকালে আরও আটটি প্রতিষ্ঠানকে কঠোর সতর্কতামূলক পত্র দেওয়া হয়। পরে অঙ্গীকার নামা দেওয়ায় তাদের স্টল চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। মেলা শুরুর প্রথম পর্যায়ে নীতিমালা ভঙ্গের কারণে দু’টি প্রতিষ্ঠানের দু’টি বই কমিটি কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং আরও একটি বইয়ের প্রচারণা না করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পত্র দেওয়া হয়।
উৎসর্গকরণ
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে তিনটি অংশে ভাগ করে নামকরণ করা হয়। শেখ রাসেল শিশু চত্বর, বঙ্গমাতা চত্বর এবং বঙ্গবন্ধু চত্বর। এছাড়া বাংলা একাডেমি অংশকে চিত্তরঞ্জন সাহা চত্বর নামে নামকরণ করা হয়।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার
এবার গ্রন্থমেলায় অন্যান্যবারের তুলনায় বেশি হারে ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দেওয়অ হয়েছে। বইমেলার তথ্যফরম, আবেদনপত্র, ভাড়া গ্রহণ ইত্যাদি সবকাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়েছে। ফলে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়েছে। বইমেলা নিয়ে নির্মিত বাংলা একাডেমির নিজস্ব ওয়েবসাইটি রয়েছে। মেলার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দর্শক-ত্রেতাদের সেবা দিয়েছে। এছাড়া এবার প্রচুর ই-বুক, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বই প্রকাশিত ও বিক্রি হয়েছে।
সেবাসমূহ
বাংলা একাডেমি অন্যান্য বারের মতো এবারও তথ্যকেন্দ্র, নামাজের স্থান, ব্রেস্টফিডিং কর্নার, সরাসরি সম্প্রচার, নিরাপত্তা, মোড়ক উন্মোচন, মাসব্যাপী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেলায় আগত লেখক, প্রকাশক এবং আগ্রহী পাঠক ক্রেতা দর্শনার্থীদের সেবা দিয়েছে।
চারটি স্মৃতি পুরস্কার
গুণীজনদের স্মৃতিতে একাডেমি এবার বইমেলায় চারটি পুরস্কার দিয়েছে। এগুলো হলো— চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার।
নতুন বই ও মোড়ক উন্মোচন
তথ্যকেন্দ্রের দেয়া তথ্যানুযায়ী এবার ৩ হাজার ৭৩০টি নতুন প্রকাশিত হয়েছে। গতবছর ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই বের হয়েছিল। গতবারের মতো এবারও বাংলা একাডেমির একটি কমিটিকে দিয়ে প্রাপ্ত সকল বইয়ের মান প্রাথমিকভাবে নিরুপণের চেষ্টা করা হয়েছে। নিবন্ধন করা মোট মোড়ক উন্মোচিত বইয়ের সংখ্যা ৭২২টি।
এবারের মেলায় নতুন সংযোজন ও পরিমার্জন
মেট্রোরেলের স্টেশনটি মেলার সোহরাওয়ার্দী অংশে প্রবেশের মূল পথে পড়ায় পুরো মেলার বিন্যসে পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি। গতবছর বিন্যাসে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে বরাদ্দকৃত ১৮২টি স্টল ও ১১টি প্যাভিলিয়নের স্বত্বাধিকারীরা বার বার অনুরোধ করেছিলেন যাতে ওই অংশে পরবর্তীকালে যেন স্টল বরাদ্দ না দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে এবার বইমেলার বিন্যসে নতুনত্ব আনা হয়। প্যাভেলিয়ন এবং স্টলগুলো আলাদা আলাদা সারিতে সন্নিবেশ করে প্রতি সারি এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয় যাতে মেলার যেকোনো সারির এক প্রান্তে দাঁড়ালে অপর প্রান্তের শেষ অবধি দেখা যায়।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম