বিদেশে স্থায়ী শহিদ মিনার নিয়ে তথ্য নেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
১ মার্চ ২০২৩ ০০:২৬
ঢাকা: বাংলাদেশের বাইরে যে সব মিশনে স্থায়ী ভবন আছে, সেগুলোতে স্থায়ী শহিদ মিনারের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে।
দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাস, হাইকমিশন, কনস্যুলেট, উপ-হাই কমিশন ও সহকারি হাই কমিশনে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মাঝে ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়ে থাকে। তবে দেশের বাইরে স্থায়ী শহিদ মিনার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি শাখার মহাপরিচালক ও মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশে অবস্থিত যেসব মিশনে স্থায়ী ভবন আছে, সেগুলোতে স্থায়ী শহিদ মিনারের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এই মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেই। তবে পরবর্তী সময়ে এ সংক্রান্ত তথ্য জানানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নেদারল্যান্ডসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে স্থায়ী শহিদ মিনার রয়েছে। এছাড়াও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন ও প্রবাসী বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে স্থায়ী শহিদ মিনার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস, হাইকমিশন, কনস্যুলেট, উপ-হাইকমিশন ও সহকারী হাইকমিশনে পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে মিশনগুলোতে স্থাপিত অস্থায়ী শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।’
উল্লেখ্য, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের পেরিস সিটিতে নির্মিত স্থায়ী শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশের কেন্দ্রিয় শহিদ মিনারের আদলে এ শহিদ মিনারটিতে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্যারিস সিটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন কমিটির নিরলস প্রচেষ্টা, পেরিস সিটি মেয়রের ঐকান্তিক উদ্যোগে এ শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ উদ্যোগের সঙ্গে লস এঞ্জেলেস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট সম্পৃক্ত হয়।
সেহেলি সাবরিন বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বাংলাকে প্রথম বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন। তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে ‘জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা’ (ইউনেস্কো) ২১ ফেব্রুয়ারিকে সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি দেয়।’
এর আগে, দেশের বাইরে প্রথম শহিদ মিনার স্থাপিত হয় উত্তর লন্ডনে। স্থানীয় বাঙালি কাউন্সিলরদের দাবির মুখে ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের জমি এবং নগদ অর্থ বরাদ্দের সুবাদে স্থানীয় বাঙালিদের কয়েকটি সংগঠনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ওই শহিদ মিনারটি গড়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর শহিদ মিনার স্থাপনের কাজ শেষ করা হয়। এটি নির্মিত হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে।
এটি নির্মাণের ঠিক তিন বছর পর আরেকটি শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা পূর্ব লন্ডনে। বাঙালিদের উদ্যোগেই তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহাসিক আলতাব আলী পার্কে। এরপর শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে লুটন শহরে।
জাপানের রাজধানী টোকিওর প্রাণকেন্দ্র তোসিমা সিটিতে ন্যাশনাল থিয়েটার হলের পাশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলেই ২০০৫ সালে নির্মিত হয়েছে একটি মিনার। জাপান সরকারের বরাদ্দ দেওয়া জমিতে এই মিনারটি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে।
একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ওমানে গড়ে উঠেছে শহিদ মিনার। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে নির্মিত এ মিনারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত গোলাম আকবর খন্দকারের উদ্যোগে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন জনপদে সগৌরবে মাথা তুলে রয়েছে শহিদ মিনার। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ধর্মতলার কার্জন পার্কে শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৯৮ সালের ২৬ মে স্মারক স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়। বাংলা ভাষার শহিদদের স্মরণে ওপার বাংলায় দ্বিতীয় শহিদ মিনার স্থাপিত হয় ২০১১ সালে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে। ২৫০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে ১১ ফুট উচ্চতায় গড়া হয়েছে এই শহিদ মিনার। পশ্চিমবঙ্গে এ ছাড়াও আরও দুটি ভাষা শহিদ মিনার রয়েছে। এর একটি হলদিয়ায়, অন্যটি চন্দননগরে।
আসামের শিলচরে আরেকটি শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে ১৯৬১ সালে, সেখানে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে। ১৯৯৯ সালে বাংলা ভাষার শহিদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে আগরতলা, আসাম, মেঘালয়, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড় রাজ্যের বিভিন্ন জনপদেও নির্মিত হচ্ছে অস্থায়ী শহিদ মিনার। ভারতের বাইরে বাকি বিশ্বেও সগৌরবে মাথা উঁচু করছে বাংলা ভাষার শহিদ মিনার। এ সংখ্যা ইতিমধ্যে ১০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।
শহিদ দিবস থেকেই উৎপত্তি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। সেভাবেই শহিদ মিনার থেকেই বর্ধিত হয়েছে- ভাষা বিষয়ক মনুমেন্ট। সেই নতুন মাত্রা যুক্ত করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অ্যাশফিল্ড হেরিটেজ পার্কে একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে ২০০৬ সালে নির্মিত হয়েছে একটি শহিদ মিনার। ২০০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি স্থাপিত এই মনুমেন্টকে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ বলে দাবি করা হয়ে থাকে।
আরও ভিন্ন মাত্রায় কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের সাথে শহরের বিয়ার পার্কে ২০০৯ এর ১১ জুলাই উদ্বোধন করা হয় ভাষার নান্দনিক মনুমেন্ট লিঙ্গুয়া অ্যাকুয়াং। এটি শুধু মাত্র বাংলা ভাষারই নয়, পৃথিবীর বিলুপ্ত এবং বেঁচে থাকা সকল ভাষার গৌরবোজ্জ্বল প্রতীক।
ইউরোপে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের পর ইতালির আদরিয়াটিকো সাগরের কূলঘেঁষা বন্দর শহর বারিতে নির্মিত হয় শহিদ মিনার। ইতালির দ্বিতীয় শহিদ মিনার স্থাপিত হয় রাজধানী রোমে। ভিয়া পানামার ইসহাক রবিন পার্কে এটি নির্মিত হয় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফ্রান্সের বাঙালি কমিউনিটি প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষা শহিদদের স্মরণ করে থাকে অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা হলে ফ্রান্সের বাঙালি কমিউনিটির চেষ্টায় প্যারিসে স্থায়ী শহিদ নির্মাণ হয়েছে। প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েনি ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডাও।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম