বইমেলার শেষ দিনের ভিড় ছিল ২১শে’র মতো
১ মার্চ ২০২৩ ০০:৪১
বইমেলার শেষ দিন বিকেল সাড়ে ৪টা। টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশ পথে মানুষের দীর্ঘ সারি। এবার বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অংশে এ গেট দিয়েই ৯০ ভাগ মানুষ প্রবেশ করেছে। আর ‘প্রধান প্রবেশ পথ’ কালী মন্দির গেট দিয়ে প্রবেশ করেছে বাকি ১০ ভাগ লোক। সঙ্গত কারণেই মেলার ২৮ দিনই এই গেটে ছিল মানুষের দীর্ঘ সারি। ব্যতিক্রম ছিল না শেষ দিনটাও।
মানুষের দীর্ঘ সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে বইমেলায় ঢুকতে গেলে প্রথমত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত দূষিত ধুলায় নাক-চোখ-কান-গলা সর্বপরি ফুসফুস আক্রান্ত হবে। সবদিক বিবেচনা করে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের অনুরোধ করে বিশেষ ব্যবস্থায় মেলায় ঢুকে পড়া।
যেদিক চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। অমর একুশে বইমেলার ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে পরিমাণ মানুষ মেলায় আসে, পর্দা নামার বিকেলটিতে ঠিক যেন সেই পরিমাণ মানুষই মেলায় ঢুকেছে। এলো-মেলো, দিগ্বিদিক ছোটা-ছুটি করে যারা আনন্দ পান, তারা তাই করছেন, যারা গল্প করে আনন্দ পান, তারা গল্প করছেন। যাদের আনন্দ ছবি তুলে, তারা ছবি তুলছেন। যারা প্রেমে খোঁজেন নৈস্বর্গিক আনন্দ, তারা প্রিয়জনের সঙ্গ সময় কাটানোর জন্য বেছে নিয়েছেন অমর একুশে বইমেলার বিদায়ী সন্ধ্যাটাকে। আর যারা আনন্দ খুঁজে পান বইয়ের পাতায়, তারা স্টল-প্যাভিলিয়নে ঢুঁ মেরে শেষ মুহূর্তে কিনে নিচ্ছেন পছন্দের বই, যে বই কোনো দিন তাকে ছেড়ে যাবে না।
প্রতিদিনের মতো শেষ দিনটাতেও বড় প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নগুলোতে প্রচণ্ড ভিড় চোখে পড়ল। প্রথমার প্যাভিলিয়নে লেখক আনিসুল হক, আসিফ নজরুল, কবির বকুল ও সুমন্ত আসলাম অটোগ্রাফ ও সেলফি শিকারীদের আবদার পূরণ করছিলেন। বই বিক্রির এই পুরোনো কৌশল কোনো দিন আবেদন হারাবে না।
মেলার শেষ দিনটাতে জানতে চাওয়া হলো কোন বইগুলো বেশি গেছে এবার?— প্রথমার ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন বললনে, ‘মহিউদ্দিন আহমদ, প্রয়াত ড. আকবর আলী খান, বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের রাজনৈতিক বইগুলো ভালো গেছে। এছাড়া সদ্য প্রয়াত মাহবুব তালুকদারে ‘নির্বাচন নামা বইটিও ভালো বিক্রি হয়েছে।’
বইমেলায় চক্কর দেওয়ার সময় চোখে পড়ল ‘কিংবদন্তি’র স্টলে ‘জমাটবাঁধা’ ভিড়। একেবারে হৈ হৈ, রৈ রৈ ব্যাপার! রীতিমতো হৈ হুল্লর পড়ে গেছে। ঘটনাটা কী, জানার জন্য এগোনোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হলো। তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যবতীদের ভিড় ঠেলে সামনে এগোর কোনো সুযোগ নেই। দূর থেকেই জানা গেল, তরুণ কণ্ঠশিল্পী তাসরিফ খান বইমেলায় ‘তাশরিফ এনেছেন’। উদ্দেশ্য, নিজের লেখা ‘বাইশের বন্যা’ বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া।
এইসব দৃশ্য দেখতে যেমন ভালো লাগে, ভাবতেও তেমন ভালো লাগে যে, বইয়ের প্রতি মানুষের প্রেম আছে, আগ্রহ আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, আছে বই কেনার প্রবণতা। কিন্তু বইমেলার সদস্য সচিবের দেওয়া তথ্যে সেই আশার বসতি ঝুঁপ করে ভেঙে পড়ে। কারণ, ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলায় মানুষ এসেছে প্রায় ৬৫টি লাখ। সবাই গড়ে ১০০টাকার বই কিনলে ৬৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বই বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪৭ কোটি টাকার। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, বইমেলায় পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ঢের বেশি।
তাতে কী হয়েছে? বই বিক্রি কম হলেও বইমেলার শেষ দিনে নতুন বই এসেছে ২৬৭টি। ২৮ দিনে মোট নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৩০টি। এর মধ্যে কবিতার বই ১২৪৭টি, উপন্যাস ৪৬৬টি, গল্পের বই ৫০৩টি, প্রবন্ধের বই ১৯৭টি, গবেষণা ৭৫টি, ছড়া ৮১টি, শিশুতোষ ৭৯টি, জীবনী গ্রন্থ ১২৮টি, রচনাবলি ৪৩টি, মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থ ৮০টি, নাটক ৫৪টি, বিজ্ঞান ৫১টি, ভ্রমণ ৬৭টি, ইতিহাস ৮৭টি, রাজনীতি ৩৩টি, স্বাস্থ্য ৩৩টি, বঙ্গবন্ধু ৩৫টি, রম্যরচনা ২২টি, ধর্মীয় গ্রন্থ ৫৫টি, অনুবাদ ৬৯টি, অভিধান ১৩টি, গোয়েন্দা ৪৬টি এবং অন্যান্য ২৬৬টি বই রয়েছে।
বইমেলার শেষ সাত দিন প্রকাশক, স্টল-প্যাভিলিয়নে কর্মরত কর্মকর্তা ও বিক্রয়কর্মীদের কাছে কমন প্রশ্ন ছিল, বিক্রি কেমন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় প্রকাশনীগুলো থেকে বলা হয়েছে বিক্রি আশানুরূপ নয়। গতবারের চেয়ে খারাপ। তাদের এই বক্তব্য যে ভিত্তিহীন ছিল না, তার প্রমাণ মিলল আজকের দেওয়া পরিসংখ্যানে। গত বছর বই বিক্রি হয়েছে ৫২ কোটি টাকার। এবার বিক্রি হয়েছে ৪৭ কোটি টাকার। অর্থাৎ বিক্রি কমেছে সাত কোটি টাকা। তবে বইমেলার সদস্য সচিব তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রকশনী সংস্থাগুলো যে হিসাব দিয়েছে, সেটা বাস্তসম্মত নয়।
অবশ্য অপেক্ষাকৃত ছোট প্রকাশকেরা বলেছেন, তাদের বিক্রি গতবারের চেয়ে ভালো। বইমেলার শেষ দিন আবিষ্কার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এনডি হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবারের বিক্রি গত তিন বছরের তুলনায় ভালো। ঝর-বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় বইমেলায় প্রচুর লোক এসেছে। বিক্রিও হয়েছে প্রচুর।’
মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন বাদল সৈয়দ, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সৌম্য সালেক এবং পলি শাহিনা। বিকেল ৫ টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ‘অমর একুশে বইমেলার সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘কোভিড মহামারি পরবর্তী মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা আয়োজন সত্যিই আমাদের জন্য বড় একটি সফলতা। বিন্যাস ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে এবারের বইমেলা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।’
ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এ বাংলা একাডেমিসহ সব প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ১ কোটি ২৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আজকের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে, প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।’
কে এম খালিদ এমপি বলেন, ‘আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত এবারের বইমেলা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে এবারের মেলা।’
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় একটি দিগন্ত। বই পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে মানবিক দর্শন জাগ্রত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।’
অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে ক্যারোলিন রাইট এবং জসিম মল্লিককে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রফিক-কে কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩
অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনী-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত ‘বিচ্ছন্ন ভাবনা’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুক্স, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি বইয়ের জন্য ঐতিহ্য এবং হাবিবুর রহমান রচিত ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়।
২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট), উড়কি (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম