।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: `মালিবাগ মোড়ে নামব, বাসটা একটু থামল। আমি গেইটে আইসা পাওডা নামাইতে পারি নাই, পাওডা একটু নামাইছি, অমনি বাসওয়ালা বাসটারে টান দিলো। আমার পায়ের ওপর দিয়া বাসটা গেল’ শুক্রবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সম্পর্কে এভাবে বলছিলেন নিলুফা বেগম। ঢাকার আদাবরে এক পোশাক কারখানায় চাকরি করা এ নারী জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি রয়েছেন।
বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিলুফার পায়ের চারটি আঙুল।
তিনি বলেন, ‘ড্রাইভার যদি বাস লইয়া টান না দিত তাহলে এই অবস্থা হতো না। আঙুলগুলান বাঁইচ্যা যাইত, আজ আমার চাইরডা আঙুল নাই হইয়া গেল।’
হাসপাতালে মায়ের পাশে থাকা নিলুফার ছেলে আশিক জানান, বাসের চাকায় তার মায়ের পা আটকে যায়। পরে বাস পেছনে নিয়ে চাকার নিচ থেকে মায়ের পা বের করা হয়।
দুর্ঘটনার পর তাকে প্রথমে নেওয়া হয় সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে।
প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আসরাফ কবির জানান, নিলুফার পায়ের এক্স-রে করতে দেওয়া হয়েছে। পায়ের আঙুল কাটা পড়তে পারে। তবে এক্স-রে রিপোর্ট দেখার পর তা বোঝা যাবে।
শনিবার (৫ মে) পঙ্গু হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের নিচতলার অপারেশন থিয়েটারের সামনে মেঝেতে শুয়ে আছে নিলুফা, পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ে শেফালি। আর ছেলে আশিক দৌড়াচ্ছে হাসপাতালের এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে বিভিন্ন পরীক্ষার কাগজ নিয়ে।
নিলুফার বেগম বলেন, ‘আদাবর ১০ নাম্বারে অবস্থিত একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন নিলুফা। বাসাও সেখানেই। দরকারি একটি কাজে মালিবাগে যান গতকাল আর সেখান থেকে ফেরার পথেই ঘটে এ দুর্ঘটনা।’
পোশাক কারখানা থেকে কেউ আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ তারা ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে।’
আহত নিলুফাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা পথচারী জামশেদ আল মাইন বলেন, ‘আমি রিকশা নিয়ে মালিবাগ মোড়ে যাচ্ছিলাম। মালিবাগ মোড়ের কিছু দূর থেকে দেখি মগবাজারগামী ৬ নম্বর পরিবহনের একটি বাস থেকে নামতে গিয়ে ওই নারী পড়ে যান। এ সময় বাসের পেছনের চাকায় তার পা চাপা পড়ে।
নিলুফার ছেলে আশিকুল জানান, তারা চার ভাইবোন। বাবা গোপালগঞ্জে জমি দেখাশোনার কাজ করলেও অসুস্থতার কারণে ঠিকমত উপার্জন করতে না পারায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন নিলুফা।
ছেলে আশিকুলও আদাবরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
আশিকুল বলেন, ‘গতকাল (৪ মে) রাতেই মায়ের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। আজ (৫ মে) দুপুর দুইটায় ডাক্তাররা সময় দেন, আজও অপারেশন হয়নি। এখান থেকে একের পর এক নানা ধরনের পরীক্ষার কাগজ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোথাও গিয়েই পরীক্ষা করাতে পারিনি। কেউ কিছু বলে না এখানে ঠিক করে। আমরা গরিব মানুষ- লেখাপড়া জানি না। একেকজন এসে খালি কাগজ ধরায়ে দিয়ে যায়-কিন্তু কেউ যে বুঝায়ে কিছু বলবে সেই সময়টুকুও কেউ দেয় না।’
তিনি বলেন, ‘এক রুম থেকে কাগজ ধরায়ে বলল, ‘আর্জেন্ট পরীক্ষা করাইতে হইব, আরেক রুমে গেলে বলে, তাদের কাজ করার সময় শেষ-এভাবেই কেবল ঘুরেই যাচ্ছি।’
তবে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মোবাইল ফোনে কথা হলে আশিকুল বলেন, দুপুর দুইটা পার হলেও নিলুফার বেগমের অস্ত্রোপচার হয়নি। তবে চিকিৎসকরা দেখে গেছেন। তারা আঙুল কেটে ফেলার পক্ষে মতামত দিলেও পরিবার থেকে এখনও তাতে সায় দেওয়া হয়নি।
আশিকুল বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের বলছি, যদি কোনোভাবে আঙুলগুলো রেখে দেওয়া যায়, চিকিৎসকরা চেষ্টা করবেন বলে কথা দিয়েছেন আমাদের।’
আর নিলুফার বেগম বলেন, ‘রোজিনা মারা যাওয়ার কত হা-হুতাশ করছি, টেলিভিশনে দেখছি। অ্যাক্সিডেন্টের পরও মেয়েটা বাইঁচা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে নাই। আপনারা দোয়া কইরেন, আমারও যেন সে অবস্থা না হয়। আমার পোলাপানগুলা যেন মা হারা না হয়।’
সারাবাংলা/জেএ/একে