Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ ভবন

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২ মার্চ ২০২৩ ১০:৪৭

ঢাকা: অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর ৫৪.৬৭ শতাংশ ভবন। এছাড়াও দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিতি চট্টগ্রামের ৫৪.২৯ শতাংশ ভবনে রয়েছে অগ্নিঝুঁকি। সামগ্রিকভাবে সারাদেশের ৩৮.৮৭ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে থাকা এই সব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

তবে অগ্নিঝুঁকি চিহ্নিত করা গেলেও এইসব ভবনকে কিভাবে নিরাপদ করা যায় তা নিয়ে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একাধিকবার সতর্ক করা হলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। শুধুমাত্র বড় কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামনে এলে তখন কিছুদিন আলোচনা হয়, এরপর সেটাও থেমে যায়। আইনি ক্ষমতা না থাকায় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিতে পারে না বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। বড় কোনো দুর্ঘটনার পরে কিছুদিন আলোচনায় না রেখে সারা বছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সমন্বিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। একইসঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে এনে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নাগরিকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও বহুতল ভবনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে খুব দ্রুত এর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদনটি তৈরি করতে পাঁচ হাজার ৮৬৯টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মাঝে দুই হাজার ২২৩টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার মাঝে দেখা যায়, ৬৭১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং এক হাজার ৬০৬টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এই সময়ে অগ্নিনিরাপত্তায় ৩ হাজার ৯৬টি ভবনে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৫৪.৬৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে ১.৯৩ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে ৫৪.২৯ শতাংশ ভবনে। এছাড়া বরিশালে ২৯.৬২ শতাংশ, খুলনায় ৪১.৪৬ শতাংশ, রংপুরে ২৪ শতাংশ, সিলেটে ১৯.৭৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৪.৯৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ১.৯৩ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি এক হাজার ১৬২টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মাঝে ৬৩৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। যার মধ্যে ১৩৬টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রতিবেদনে রাজধানীর ৫২৭টি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সন্তোষজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ৬৭৬টি ভবন পরিদর্শন করে ৯১০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। এ এলাকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৪৬৩টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে আগুন জ্বলছে

এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন করা ভবনগুলোর তথ্যানুযায়ী, বরিশালে ৬৯২টি ভবন পরিদর্শন করে ২০৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

খুলনায় ৪১০টি ভবন পরিদর্শন করে ১৭০টি, রাজশাহীতে ৯৩৫টি ভবন পরিদর্শন করে ১৪০টি, রংপুরে ৫১২টি ভবন পরিদর্শন করে ১২৩টি, সিলেটে ১৭২টি ভবন পরিদর্শন করে ৩৪টি এবং ময়মনসিংহে ৩০৬টি ভবন পরিদর্শন করে ৬টি ভবন অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

এর আগে ঢাকায় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ২০১৭ সালে ভবনগুলোর ওপর বিশেষ জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস। হাসপাতাল, মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও উঁচু ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকার অধিকাংশ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ওই রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার ৯৬ শতাংশ বিপণিবিতান, ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রতিবেদন আরও বলা হয়, সারা দেশে সবচেয়ে বেশি ৩৮.৪৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এছাড়া বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৬.০৮ শতাংশ, চুলা থেকে ১৩.৯৮ শতাংশ এবং ১৬.৯৭ শতাংশ অজ্ঞাত কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দৈবচয়নের ভিত্তিতে বা সাধারণত কিছু বিষয়কে প্রাথমিক মানদণ্ড মেনে এই ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। এর মাঝে রয়েছে ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি খতিয়ে দেখা। এসব তথ্য পর্যালোচনা করা ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক করা হলেও সরকারি কিংবা বেসরকারি কর্তৃপক্ষ কেউই আমলে নেয় না। আইনি ক্ষমতা না থাকায় কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিতে পারে না ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপরেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে মালিকদের চিঠি দেই। আমাদের কাজ সমস্যা চিহ্নিত করা, মানুষকে সচেতন করা। আমাদের কাজ বল প্রয়োগ করা নয়। যারা মানছে না আমরা তাদেরও চিহ্নিত করি। আইন প্রয়োগ করার জন্য অন্য সংস্থা রয়েছে।’

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তার সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। এসব সেবাসংস্থার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ঘাটতি আছে। যথাযথ সমন্বয় ও আইনের প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন। তবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের কঠোর হতে হবে।

তিনি বলেন, ‘সংস্থাগুলোর মধ্যেও অনেক সময় ভীতি কাজ করে। কেননা বহুতল ভবনগুলোর মালিক সবাই প্রভাবশালী। কখন কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কী হয়ে যায়, তাদের ভেতর এমন এক ধরনের চাপ কাজ করে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের একদম কিছু করণীয় নেই বললে, সেটা আসলে সঠিক হবে না। তাদের অবশ্যই করণীয় আছে। ভবন নির্মাণের আগে তারা সার্টিফিকেট দেয়। অগ্নিনির্বাপক ব্যাবস্থা যথাযথভাবে অনুসরণ করা না হলে সেই ভবনের অনুমোদন বা সনদ দেওয়ার কথা না। যারা ফায়ার সেফটি ছাড়া ভবন নির্মাণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে আমাদের এখানে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বা কোনো দুর্ঘটনার পরে দায়িত্ব আরেকজনের ঘাড়ে চাপানোর একটা সংস্কৃতি আছে। এটা আসলে মূল সমস্যা সমাধানের পথে একটা বাধা।‘

ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামই শুধু না বর্তমান সারাদেশেই সতকর্তামূলক ব্যবস্থার ঘাটতি থাকার কারণে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে যে শহরে প্রস্তুতি নাই বা এমনকি রাষ্ট্রের প্রস্তুতি নাই সেখানে কেনো আমরা এমন হাইরাইজ মডেল দিয়ে ভবন তৈরি করেই যাচ্ছি সারা দেশজুড়ে। এ ভুলটা আমরা করেই যাচ্ছি। এক্ষেত্রে বড় শহরগুলোর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ছোট শহরগুলোর ক্ষেত্রে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনকেই ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোল ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নিয়ে এসব বিষয়ে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় রাজউকের কাছে পরিকল্পনার কাগজ জমা হয়ে থাকে। মূলত তারাই হচ্ছে কাস্টডিয়ান এক্ষেত্রে। একটা ভবনের ফায়ার সেফটি সব ঠিক আছে কিনা সে বিষয়ে তাদেরও ভূমিকা থাকে। ভবনের পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পরে সেখানে ফায়ার সেফটি ইস্যুতে কমপ্লায়েন্স আছে কিনা তাও তাদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তো এগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই করার কথা। ভবনমালিকদের পাশাপাশি আমাদেরও কিছুটা সচেতনতার জায়গা থাকে এখানে। আগুনের সূত্রপাত হতে পারে এমন কিছু ভবনে আছে কিনা তা চেক করা প্রয়োজন।’

ড. আদিল বলেন, ‘বাড়ির মালিক বা ভবনের দায়িত্বে যারা থাকছেন তাদের নিরাপদে থাকার জন্য কী কী করণীয় সেটা রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারে। ভবনের ভেতরে আগুন থেকে বাঁচার জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের পরিকল্পনা যে শুধু বহুতল ভবনই করতে পারে বিষয়টা কিন্তু তেমনও না। যেমন দেখা গেলো স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ভবনে সেগুলো বহুতল না কিন্তু তাও সেখানে ফায়ার সেফটি এক্সিট থাকা জরুরি। যার যার করণীয় ঠিক করে দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে তার ফায়ার ফাইটিং সার্ভিসের সামর্থ্য বাড়ানো নিয়েও কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়েও কাজ করাতে হবে। এক্ষেত্রে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় এই স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি সামাজিক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যেকোনো দুর্যোগ প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়া যায়। ফায়ার সার্ভিস বা অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষ কখন আসবে তার অপেক্ষা করতে করতে একটি প্রাণও হারানো দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলোতে দেখা যায় আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের যে গাড়িগুলো আছে সেগুলো অনেক সময় আগুন লাগা ভবনে পৌঁছাতেও কষ্টসাধ্য হয়ে যায় নানা কারণে। এক্ষেত্রে বড় বড় গাড়িগুলোর পরিবর্তে বিকল্প কিছুও ভাবা যেতে পারে। যেমন বড় গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না এমন সরু রাস্তাগুলোতে ছোট গাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। একইভাবে কাস্টমাইজ সাইজের বিভিন্ন গাড়ি পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশে যা আমাদের এখানে নেই। এছাড়াও দেখা যায় ফায়ার বল টাইপের অনেক কিছু পাওয়া যায় যা স্বেচ্ছাসেবকরাও ব্যবহার করতে পারে।’

ড. আদিল বলেন, ‘নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতেই হবে। কিন্তু আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র এখন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে বলে মনে হয়। এখন ব্যবসায়ীরাই তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করে। এক্ষেত্রে এটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থে সংঘাতের মতো বিষয় হয়ে যায় আর তাই তারা কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ হতে পারে না। এটা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে অনেক বিপজ্জনক হতে পারে।’

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এবং প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমস্ত ব্যবস্থাপনা প্রতিবছর নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে করা হচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারে সতর্ক পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রতি বছর সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা দরকার যেখানে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সসহ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যুক্ত থাকবে। এর ফলে যে সমস্ত জায়গা থেকে আগুন লাগতে পারে সেটা সুইচ বোর্ড হোক বা শর্ট সার্কিটের বিভিন্ন জায়গা হোক বা এইচডিবি বোর্ড বা ডিবি বোর্ড হোক, ডিস্ট্রিবিউওশন বোর্ড হোক অথবা গ্যাসের সংযোগ বা লিফট – এগুলোর প্রতি বছর সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘একবার বিদ্যুতের সংযোগ লাগিয়েছে বা গ্যাস সংযোগ লাগিয়েছে অথবা লিফট লাগিয়েছে বলে, বছরের পর বছর তার অবস্থা কী আছে বা কি হয়েছে সেটা যথেষ্ট পুরনো বা সেগুলো বিপজ্জনক বা অভিঘাত সম্পন্ন হলো কিনা তা পরীক্ষা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে কাজগুলো করা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে বাড়বার একথাগুলো বলে যাচ্ছি। কিন্তু সেই কাজগুলো হচ্ছে না। কিছুদিন আগে গুলশানের একটি ভবনে আগুন লাগলো। সেখানেও আমরা দেখলাম প্রায় একই রকমের অবস্থা। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকার পরেও প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। কারণ সেখানের বাসিন্দাদের মাঝে আগুন প্রতিরোধের প্রাথমিক ধারণা অভাব ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়মিত এবং আকস্মিক মহড়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মনোগত এবং অভ্যাসগত চর্চায় নিয়ে আসা হয়।’

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যে কেউ যদি জানে কোথায় সিঁড়ি রয়েছে বা সেখানে কিভাবে যেতে হবে জরুরি পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন। কেউ যদি অন্ততপক্ষে বার দশেক সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তার ক্ষেত্রে যাওয়াটা সহজ হতে পারে। সেজন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে বছরে অন্তত ছয় বার ফায়ার ব্রিগেড সিভিল ডিফেন্সের তত্ত্বাবধানে মহড়ার ব্যবস্থা করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল বাড়বেই। আমরা আধুনিক ভবন, আধুনিক সভ্য দেশ, স্মার্ট লিভিং যাই বলি না কেনো তা আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই রাখবে না।

উল্লেখ্য, দেশে ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। একই বছর ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৭০ জন আহত হন। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারান।

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০৭ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। আর উদ্ধার করা মালামালের আনুমানিক মূল্য ১ হাজার ৮০৮ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৬০ টাকা। এ ছাড়া ৯ হাজার ৫১৭টি অগ্নিকাণ্ডের অপারেশনে যাওয়ার আগে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

এসব অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে পুরুষ ৭২ জন ও নারী ১৩ জন। অগ্নিনির্বাপণে গিয়ে দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হয়েছেন ১৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০৭ জন।

সারাবাংলা/এসবি/এমও

অগ্নিঝুঁকি ফায়ার সার্ভিস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর