রোজার আগেই মাছ-মাংসে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস
৩ মার্চ ২০২৩ ২৩:০৫
ঢাকা: রাজধানীর সুত্রাপুর মাংসের বাজার। আবির গোশতের দোকানে অনেক মানুষের ভিড়। ফাঁক দিয়ে এক নারী উঁকি দিচ্ছেন বারবার। কিছু একটা বলতে চাইছিলেন তিনি। তবে অস্পষ্ট কথা। কিন্তু মাংস বিক্রেতা তার দিকে চাইছেন না। আজ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি দরে। কেউ দুই কেজি কেউ এক কেজি বা সোয়া কেজি কিনছেন। তবে বেশিরভাগ লোক এক হাজার টাকার মাংস কিনছেন। লোকজন সরে গেলে ওই নারী এগিয়ে এসে বলেন, ‘আমাকে আড়াইশ গ্রাম মাংস দিন তো।’ দোকানদার শুনেই দুচার কথা শুনিয়ে দিলেন। বললেন, এক পোয়া গোসত হবে না। ৭৫০ টাকা কেজি। অনেক কাকুতি মিনতি করেও ওই নারী গোসত পেলেন না।
ওই নারীকে এই প্রতিবেদকের জিজ্ঞাসা, এত কম মাংস কিনতে চাচ্ছেন কেন? ওই নারী বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। ক্লাস ফোরে পড়ে। অন্তত চার মাস হলো গরুর গোশত খাইনি। গতকাল স্কুলে যাওয়ার সময় ছেরৈ জেদ ধরেছে যে, শুক্রবার যেন তাকে গরুর মাংস দিয়ে ভাত দিই। আমি অন্যের বাসায় কাজ করি। ছেলের বাবা রিকশা চালায়। ২০০ টাকা নিয়ে আসছি গরুর গোশত কিনতে। কিন্তু দোকানদার গোশত দিলেন না। আমার কাছে ২০০ টাকার বেশি নেই।’
পরে দোকানদারকে অনেক অনুরোধ করে ওই নারীর মাংস কেনার ব্যবস্থা করা হয়।
গোশত বিক্রেতা আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি গরু জবাই করলে খুব সীমিত লাভ হয়। অল্প মাংস বিক্রি করতে গেলে, নানা সমস্যা তৈরি হয়। হাড় নেবে না, চর্বি নেবে না, ওই মাংস নেবে না, সেই মাংস নেবে না। তাই আমরা অল্প মাংস বিক্রি করতে পারি না। আমাদের তো হাড়, চর্বি সবই বিক্রি করতে হয়। গরুর মাংস এখন ৭৫০ টাকা বিক্রি করেও পোষাতে পারছি না। রোজা মাসে ৮০০ টাকা বিক্রি করতে হবে। না হলে লোকসানে থাকতে হবে।’
একই বাজারে পাশের মুরগির দোকানে গন্তব্য এবার। মুরগির দোকানে ব্রয়লারের চাহিদাই বেশি। যদিও দাম অনেকটিই নাগালের বাইরে। এই তো তিন সপ্তাহ আগেই ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল মাত্র ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি। আর আজ বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৫০ টাকা কেজিতে। রাজধানীর বাজারভেদে এই দাম কোথাও কোথাও ২৬০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে।
সূত্রাপুরের এই মুরগির দোকানে বেশির ভাগ ক্রেতাই নারী। তাদের মধ্যে একজনকে দেখা যায় খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। এক কেজি সাইজের একটি ব্রয়লার মুরগি কিনতে এসেছেন। তবে সেই সাইজের মুরগি নেই। একটি মুরগির যে ওজন হয় আর যে দাম হয় তা নেই ওই নারীর কাছে। তখন তিনি কাটা মুরগির দিকে চোখ ফেরালেন। দাম জিজ্ঞেস করলেন। দোকানি বললেন, কাটা মুরগির কেজি ৩৫০ টাকা। দাম শুনে একবার কাটা মুরগির দিকে আরেকবার আস্ত মুরগির দিকে তাকাচ্ছেন। অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত কাটা মুরগি হাফ কেজি কিনে নিয়ে চলে গেলেন।
একটু এগিয়ে জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘নিউজ করে কী হবে?। দাম তো কমে না বরং বাড়ে। ঢাকায় থাকা হবে না বুঝছি। গ্রামে গেলে ভাত পাই না, আর ঢাকায় আইলে ভাত খাওয়ার তরকারি পাই না। কেমনে বাঁচব আল্লাহ জানে।’
শুক্রবার (৩ মার্চ) সকালে যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, চাষ করা মাছে বাজার সয়লাব। ভোরে বিক্রি শুরু হয়ে সকাল ৮টার মধ্যে বেচাকেনা শেষ। পাইকারি বাজারে ২ কেজি সাইজেই একেকটি রুই মাছের দাম ৩০০ টাকা কেজি। তাহলে খুচরা বাজারে সেটির দাম পড়বে কমপক্ষে ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি। তিন কেজি সাইজের রুই মাছের দাম পাইকারি ৩৫০ টাকা কেজি। খুচরা বাজারে গিয়ে তা বিক্রি হবে ৪০০-৪৫০ টাকা কেজি। তেলাপিয়া মাছের দাম পাইকারি ১৫০ টাকা কেজি। গুলশা টেংরার দাম পাইকারি ৫০০ টাকা কেজি। কাতল ৩০০ টাকা কেজি। এ ছাড়া অন্যান্য মাছের দামও অনেক বেশি।
কাপ্তান বাজারে মাছের খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মোটামুটি মাছের বাজারে আগুন লেগেছে। সাধারণ ক্রেতারা মাছের দামই করতে পারছে না। তেলাপিয়া মাছের কেজি ২২০ টাকা, টেংরা মাছের কেজি ৯০০ টাকা, রুই মাছের (দুই আড়ই কেজি সাইজ) প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, পাঙ্গাস মাছের কেজি ১৭০ টাকা, শিং মাছের কেজি ৫০০ টাকা কেজি, পাবদা মাছের কেজি ৬০০ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছের দামেও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভেটকি, টুনা আর চাপিলার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কেজি প্রতি ৪০-৫০ টাকা। বোয়াল মাছের কেজি ৬০০ টাকা আর কই মাছ ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
তিন বাজার ঘুরে জানা যায়, সাধারণ ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সামনে রমজান আসছে। তার আগেই বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বাজার ব্যবস্থাপনার কোথাও কোনো সমন্বয় নেই। বাজার তদারকি নেই। কেন দাম বাড়ছে, কে দাম বাড়াচ্ছে তার খোঁজ নেবে কে? সরকার বেশি বেশি তদারকি করলে এরকম অস্থিরতা থাকবে না বলে মত দেন ক্রেতারা। রমজান মাস এলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মিডিয়া এনে দু একটি অভিযান চালানো হয়। দু একদিন ঠিক থাকে। এরপর যা তাই হয়ে যায়। তারা বলছেন, মাছ, মাংস, ডিম, চিনি সবই নাগালের বাইরে চলে গেছে, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় সরকারকেই ভাবতে হবে।
এদিকে বিক্রেতারা বলছেন, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছ ও মাংসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে তো মাছ মাংস ছাড়াও অন্য সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কই সেগুলো নিয়ে মানুষ কথা বলছে না। শুধু মাছ মাংসের দাম বেড়েছে তাতেই মানুষ দিশেহারা। আমরাও চাই দাম কম থাক। তাহলে ক্রেতারা যেমন বেশি কিনবে তেমনি আমাদের বেশি বিক্রি হবে এবং বেশি লাভ করা সম্ভব হবে।
বাজারে অস্থিরতার কারণ জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর শাহরিয়ার বলেন, ‘বাংলাদেশের পণ্যের বাজার যেভাবে অস্থির হয়ে উঠছে। তাতে ভোক্তা অধিকারের মতো সামান্য জনবল নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সবাই সঠিক ভূমিকা পালন না করলে এরকম শত শত ভোক্তা অধিকারের মতো প্রতিষ্ঠান জন্ম হলেও কোনো কাজে আসবে না। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি রমজানে যেন বাজার অস্থির হয়ে না ওঠে সে জন্য তদারকি করা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে