হল ও দলের পর এবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কার ৫ শিক্ষার্থী
৪ মার্চ ২০২৩ ১৯:২২
কুষ্টিয়া: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে জড়িতদের শোকজ করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া শোকজের সন্তোষজনক জবাব না দিলে কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানা গেছে।
শনিবার (৪ মার্চ) বেলা ১২টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের কার্যালয়ের কনফারেন্স কক্ষে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা চলে ২টা পর্যন্ত।
সভা শেষে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘অভিযুক্তদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বহিষ্কৃতরা হলেন- পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের সানজিদা চৌধুরী অন্তরা। এছাড়া অন্যরা হলেন- ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান, আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মিম এবং চারুকলা বিভাগের হালিমা আক্তার ঊর্মি। এই চারজন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। এর আগে তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল থেকে তাদের আবাসিকতা বাতিল করা হয়। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তরা হল ছাড়েন। অন্তরা সরাসরি ক্যাম্পাসে না এসে অন্যের মাধ্যমে মালামাল নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
এদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ১ মার্চ পাঁচজনকেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। একইদিনে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলমকে প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ।
বঙ্গমাতা হলে থাকবেন ভুক্তভোগী
হল পছন্দ করতে এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভুক্তভোগী ফুলপরি খাতুন ও তার বাবা আতাউর রহমান ক্যাম্পাসে আসেন। এ সময় ফুলপরি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন। পরে তাকে পছন্দমতো হলে মনোনয়ন দেওয়া হয়। মনোনয়ন শেষে দুপুর দুইটার পর তিনি বাড়ি চলে যান। ১ মার্চ হাইকোর্ট শুনানি শেষে এমন একটি আদেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মিয়া মো. রাসিদুজ্জামান বলেন, ‘ফুলপরি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল ছেড়ে দিয়েছে এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ওঠার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে একটি কক্ষে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল, সেজন্য ফুলপরিকে সিঙ্গেল সিট দেওয়া হয়েছে।’
ফুলপরি খাতুন বলেন, ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে আমার ভয় ও শঙ্কা রয়ে গেছে। ওখানে থাকা এখন নিরাপদ মনে করছি না। এজন্য হল পরিবর্তনের আবেদন করেছি।’ প্রক্টর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘ফুলপরিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে ক্যাম্পাসে আনা হয়েছে। ক্যাম্পাসে অবস্থানকালীন তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সচেষ্ট থাকব।’
স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি
এদিকে, ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা ও ছাত্র সংগঠনগুলো। শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, বিবৃতি প্রদান, মৌন মিছিল, মশাল মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে- বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জিয়া পরিষদ, সাদা দল, জাতীয়বাদী কর্মচারী ও কর্মকর্তা ফোরাম, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্র ফ্রন্ট। সেইসঙ্গে ভুক্তভোগী ফুলপরি ও তার পরিবারের সদস্যরাও স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন।
ফুলপরি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যারা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার চাই, পরবর্তী সময়ে কেউ যেন আর কারোর সঙ্গে এমন কিছু না করতে পারে সেটাই আমার চাওয়া।’ ফুলপরির বাবা আতাউর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জড়িতেদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে পারবে কি-না আমি সন্দিহান। এ ধরনের অপারাধীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা উচিত নয়।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুখলেসুর রহমান সুইট বলেন, ‘ছাত্রী হলে নবীন ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের ঘটনা নির্যাতনের বর্বরতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে হল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও দৃশ্যমান। এমন ঘটনায় শুধু সাময়িক বহিষ্কার সমাধান নয়। এরা ক্যাম্পাসে এসে আবার যে নির্যাতন করবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? আমরা চাই প্রশাসন তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করুক। তাহলে ক্যাম্পাসে অপরাধের মাত্রা কমে যাবে বলে মনে করছি।’
উদ্ধার হয়নি ভিডিও ধারণকারীর মোবাইল
নির্যাতনে ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণকারীর মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ভুক্তভোগী। এ ঘটনায় আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও জুডিশিয়ারি তদন্ত কমিটিতেও প্রমাণ মিলেছে। ফলে সেই মোবাইল ফোন সংগ্রহ এবং ধারণ করা ভিডিও উদ্ধার করে আদালতে দাখিল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, ফোনটি হারিয়েছে নাকি লুকিয়ে রাখা হয়েছে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
ফুলপরি বলেন, ‘সেই রাতে উনারা বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও ধারণ করেছেন। কিন্তু এখনও ফোনটি উদ্ধার করা হয়নি। আমি খুব ভয়ে আছি। তারা আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে ভিডিওটি ছড়িয়ে দিতে পারে। আমি এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমি চাই, যেন দ্রুত ফোনটি উদ্ধার করে ভিডিও নষ্ট করা হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার ঊর্মীর ফোনে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। ঊর্মী অপ্পো সি-ওয়ান মডেলের একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন। ওই ফোনেই ভিডিও ধারণ করা হয় বলে দাবি ফুলপরীর। ঘটনার পর থেকে উর্মী আর সেই ফোন ব্যবহার করছেন না।’
অভিযুক্তের ভাষ্য, ভুক্তভোগীর অভিযোগ দেওয়ার দিন ফোনটি হারিয়ে গেছে। তবে এ বিষয়ে থানায় কোনো জিডি করা হয়নি। স্মার্টফোনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঊর্মি বলেন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি ডায়না চত্বরে অনুষ্ঠানে স্টেজ পারফরম্যান্স করার সময় আমার ফোনটি হারিয়ে গেছে। জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমার আগেও ফোন হারিয়েছে। এজন্য আর জিডি করা হয়নি।’
সূত্র মতে, ঘটনার রাতের বিবস্ত্র ভিডিওটি হালিমা আক্তার ঊর্মির স্মার্টফোনে ধারণ করা হয়। পরে ঘটনা জানাজানি হলে ফোন থেকে ভিডিও ডিলিট করা হয়। প্রমাণ লোপাট করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ফোন হারানোর নাটক সাজায় ঊর্মি। ফোনটি নিজে থেকে গায়েব করে এরপর থেকে তিনি একটি বাটন ফোন ব্যবহার করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফোন উদ্ধারের বিষয়ে হল কর্তৃপক্ষের একটি চিঠি পেয়েছি। ফোনের বিস্তারিত তথ্য না থাকায় বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠিটি হল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। এখনো বিস্তারিত তথ্য পাইনি। শনিবার ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও হল ভারপ্রাপ্ত হল প্রভোস্টকে ডাকবো। যাতে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ফোনটি উদ্ধার করা হয় সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/পিটিএম