Saturday 26 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোজা ও সেচ সঙ্গে নিয়ে আসছে গ্রীষ্ম, ফের লোডশেডিংয়ের চিন্তা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ মার্চ ২০২৩ ২১:০০

ঢাকা: শীত বিদায় নিয়েছে মাস দেড়েক হলো। যে কারণে বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা। মধ্য বসন্তে তীব্র তাপমাত্রা জানান দিচ্ছে গ্রীষ্মের আগমন। এই পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সরকারের। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার গ্রীষ্ম সঙ্গে করে নিয়ে আসছে সেচ ও রমজান। ফলে সাধারণ চাহিদার চেয়েও কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। বাড়তি এই চাহিদা মেটাতে ফের লোডশেডিংয়ের চিন্তা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তবে এই লোডশেডিং গত বছরের মতো মানুষকে দুর্বিসহ করে তুলবে না।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রানুযায়ী, দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ওঠানামা করে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাহিদা আরও বাড়বে। বিদ্যুৎ বিভাগের ধারণা, ভরা গ্রীষ্মে অর্থাৎ মে মাস থেকে চাহিদা পৌঁছাবে ১৬ হাজার মেগাওয়াটে। কারণ, এবার সেচ মৌসুম ও রমজান একসঙ্গে আসছে। ফলে জ্বালানির উচ্চ মূল্যের বাজারে সক্ষমতার কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৪টি। এই সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিলো গত বছরের ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এবার যদি চাহিদা ১৬ হাজারে পৌঁছায় তাহলে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার জ্বালানি সংকটের কারণে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে গ্যাস থেকে। এছাড়া কিছুটা কয়লা আর ফার্নেস অয়েল থেকে; নবায়নযোগ্য উপায় থেকেও যৎসামান্য ধরা হয়েছে। বাকি যতটুকু ঘাটতি থাকতে সেটা পূরণ করতে যেতে হতে পারে লোডশেডিংয়ে।

সূত্রানুযায়ী, প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৬৫টি। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২২৮ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ৪৯ শতাংশ। ফার্নেস অয়েল চালিত ৬৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট। যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৬ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক ৫ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৬১২ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ। ডিজেলের ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ১ হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ৬ শতাংশ। এছাড়া হাইড্রো, অন-গ্রিড সৌর ১০ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৪৮৯ মেগাওয়াট। আর আমদানি করে আনা হয় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে বর্তমানে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তো বন্ধই করতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাবে বলে ধারণা বিদ্যুৎ বিভাগের। এই টার্গেট মাথায় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি। এজন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল আর কয়লার ওপরেই সবচেয়ে বেশি ভরসা করা হচ্ছে। এই তিন উপায় থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, আর বাকি ঘাটতি কী করে মেটানো যাবে সে পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রীষ্ম, সেচ ও রমজান এই তিন কারণে সম্মিলিতভাবে এবার চাহিদা বিগত বছরের চেয়ে অনেক বেশি হবে। আমরা যে প্রাক্কলন করেছি, তাতে এবার ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা হবে।’ তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে এপ্রিলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট। ওই সময় সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। তখন ঘাটতি কম ছিল। এবার ১৬ হাজার মেগাওয়াটকে কভার করতে আমাদের প্রস্তুতি ঠিক করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গ্যাস থেকে পাই সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকটের কারণে বছর খানেক ধরে সক্ষমতা পূরণ হচ্ছে না গ্যাস থেকে। চেষ্টা করলে গ্যাসের সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু শিল্প কারখানাগুলোকে গ্যাস দিতে হবে। আমাদের বিদ্যুতের বিকল্প আছে। কিন্তু কিছু কারখানা আছে যা গ্যাস ছাড়া চলবে না। সেসব চিন্তা করে এবার আমরা গ্যাসে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। কয়লা থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট, আর ফার্নেস অয়েল থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট আর বাকি নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে নেওয়ার পর যা থাকবে সেখানে আমাদের সামান্য কিছু ডিজেল থেকে নেওয়া হতে পারে। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে ডিজেল ব্যবহার না করা। কারণ ডিজেলের দাম অনেক বেড়েছে।’

মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘আমরা পেট্রোবাংলাকে বলেছি, আমাদের যদি সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয় তাহলে ১৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের দরকার হবে। এটা পুরোপুরি না পেলেও আমরা আশা করছি ১২০০ মতো পাব। এটা পেলেও আমরা ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অনায়াসে উৎপাদন করতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘রামপাল, পায়রা ও বরিশালের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আর বড় পুকুরিয়া মিলিয়ে কয়লা থেকে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পাওয়া যাবে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আরও ৪০০ মেগাওয়াটের মতো পাওয়া যাবে।’ এভাবেই গ্রীষ্ম মৌসুম কভারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই হিসাব ধরা হলেও আরও প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা তো ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু সেখানে তো দাম আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় যদি আধ কিংবা এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিই তাহলে দাম বাড়ানোর চাপটা মানুষের ঘাড়ে পড়বে না।’

তিনি বলেন, ‘ধরুন ১০ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা হলে এক হাজার মেগাওয়াট ঘাটতিতে দিনের ১০ ঘণ্টায় এক ঘণ্টা লোডশেডিং পাবেন। রাত ১১টার পর লোডশেডিং দরকার হয় না। এখানকার ছয় ঘণ্টা ধরে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে ১ ঘণ্টা করা হতে পারে লোডশেডিং। সেটা হতে পারে ৩০ মিনিট করে দুই বার। আর এমন হলে মানুষের গায়ে লাগবে না।’ তবে লোডশেড গত বছরের মতো দুর্বিসহ হবে না বলে আশ্বস্ত করেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক।

এদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য গ্যাস, তেল ও কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।। আগামী ৪/৫ মাসে সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ছয়শ কোটি ডলারের বেশি প্রয়োজন হবে। যা বিতরণ সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। যদিও ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় উৎপাদনে যাওয়ার ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ করে দেওয়া হয় রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি ফের উৎপাদন শুরু করা হয়। কয়লার বিল বকেয়া রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কৃর্তপক্ষকে। বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি খাতের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এই পরিস্থিতে
আসছে রমজান ও সেচ মৌসুম, সর্বোপরি গ্রীষ্মে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সংশয় রয়েছে বিভাগের।

উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের আগস্ট থেকে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় সরকার। যা এখনও বন্ধ রয়েছে। এরপর লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। শীত মৌসুম চলে আসায় শহর এলাকায় লোডশেডিং বন্ধ থাকলেও অনেক গ্রামে দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা করে লোডশেড দেওয়া হচ্ছে।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

গ্রীষ্মকাল রোজা সেচ মৌসুম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দেশে ফিরলেন মির্জা ফখরুল
২৬ অক্টোবর ২০২৪ ০১:৩০

সম্পর্কিত খবর