১১ মার্চ ১৯৭১: অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টোর তারবার্তা
১১ মার্চ ২০২৩ ০৯:০১
ঢাকা: ১১ মার্চ ১৯৭১। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারবার্তা পাঠান। ওই তারবার্তায় গত কয়েক দিনের নিপীড়ন-নির্যাতনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমঝোতার প্রস্তাব দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানো তারবার্তায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভু্ট্টো বলেন, ‘পাকিস্তানকে রক্ষা করা আমাদের সাধারণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেশের উভয় অংশ যাতে সব সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার গ্রহণ করে শান্তি ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।’
পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে পিপিপি প্রধান বলেন, ‘আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত ও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ সঙ্কটে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জন্য আমি মর্মাহত এবং তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানাই।’
শোষণ অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানে এমন একটি সুবিন্যস্ত সমাজ গঠনে সচেষ্ট, যেখানে মানুষের শোষণ অথবা অঞ্চল বিশেষের শোষণের অবসান ঘটবে। পাকিস্তানে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসুন।’
তিনি বলেন, ‘এই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সঙ্কট আজ এমন একপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, আমার মনে হচ্ছে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই অনতিবিলম্বে আমাদের মতৈক্যে পৌঁছতে হবে। পাকিস্তানকে রক্ষা করতেই হবে এবং তা যেকোনো মূল্যেই হোক।’
শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত সঙ্কট অবসানে অবিলম্বে ঢাকা সফরের কথা উল্লেখ করে ভুট্টো বলেন, ‘ঘটানোর ব্যাপারে আলোচনার জন্য আমি অবিলম্বে ঢাকা গিয়ে আপনার (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) সাথে আবার বৈঠকে মিলিত হতে প্রস্তুত রয়েছি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলে জনগণ যাতে কিছু না বলতে পারে বা ইতিহাস যাতে কোনো রেকর্ড না রাখতে পারে সে জন্য আমাদের সচেষ্ট থাকা উচিত।’
কিন্তু ভুট্টোর এই তারবার্তাকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণ কূটকৌশল ও সময়ক্ষেপণ হিসেবে দেখে। তারা সতর্ক করে দেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে যেন কোনো প্রকার সমঝোতায় না যান বাংলার রাখাল রাজা শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত ৭ মার্চের ভাষণের পরের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেই ভুট্টোর এই তারবার্তা বলে মনে করে সংগ্রামী নেতারা।
এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতারা বলেন, ‘আমরা জানতে পারলাম যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাক্ষাৎ করবেন। এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের পূর্বে আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে তার ৬ মার্চের ভাষণ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। একমাত্র এই বক্তৃতা প্রত্যাহারের পরই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান হতে পারে বলে আমরা মনে করি।’ একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধুর বাসগৃহে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন ছাত্র নেতারা। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে তারা আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট হাউজে না যাওয়ার।
আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে যেকোনো প্রকার বলপূর্বক শাসন, শোষণ ও দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে তার দল আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে।’
জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ওপর ২৩ বছরের অনাচার, অবিচার ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার প্রতিবাদে আমাদের এই স্বাধীনতার দাবি অনিবার্য হয়ে পড়েছে। বাঙালিকে তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা থেকি বঞ্চিত করার অধিকার কারও থাকতে পারে না। তাই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ও সামরিক সরকারের জোর করে কৃত্রিম সম্প্রতি রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং রক্তপাত, হানাহানির পথ পরিত্যাগ করতে হবে।’
কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ এস এম সোলায়মান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের দাবিসমূহ মেনে নিয়ে আর দেরি না করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল কাজ চালিয়ে যাবেন। বহিরাগত ও বহির্গমন জাহাজের চলাচলে বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসের যে অংশ অতি প্রয়োজনীয় তা অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে চালু থাকবে। তবে জনগণকে পীড়ন করার উদ্দেশ্যে আগত সৈন্য বা এই প্রয়োজনে আনিত জিনিস খালাসের ব্যাপারে পূর্ণ অহসযোগিতা প্রদর্শন করতে হবে।’
সারাবাংলা/এজেড/এমও