বিএনপির মিত্ররা কতটা শক্তিশালী?
১১ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৩
ঢাকা: সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে মাঠে নেমেছে ৩২টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ৩০ দল নিয়ে গঠন হয়েছে আলাদা তিনটি রাজনৈতিক জোট এবং কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কোনো জোটে না গিয়ে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
তিন জোটের ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি, রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ এবং হাসনাত কাউয়ূমের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন— এই সাতটি দল নিয়ে করা হয়েছে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’।
ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), খন্দকার লুৎফর রহমান ও এস এম শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি ও মো. আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক লীগ, গরিবে নেওয়াজ ও সৈয়দ মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বাধীন পিপলস লীগ, আবদুর রকিব ও আবদুল করিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, এম এন শাওন সাদেকী ও দিলীপ কুমার দাসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, নুরুল আমিন ব্যাপারী ও শাহ আহমেদ বাদলের নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ, নূরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল, এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী ও আবু সৈয়দের নেতৃত্বাধীন গণদল, আজহারুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফা আকন্দের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী এবং সুকৃতি মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টির সমন্বয়ে গঠন হয়েছে ১১ দলীয় ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’।
অপরদিকে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, আবদুল করিম আব্বাস ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি), মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল এবং আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি নিয়ে গঠন হয়েছে ১২ দলীয় জোট।
এছাড়া বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, শামসুল আলমের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও হারুন আল রশিদের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল নিয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ এবং মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন ‘গণফোরাম’।
গত বছর ২৪ ডিসেম্বর সারাদেশে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় এসব ‘মিত্র’ নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। তার পর থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে দলটি। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, চাল, ডাল, তেল এবং কৃষি ও শিক্ষা উপকরণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এবং বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে নিদর্লীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শনিবার (১১ মার্চ) সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে সব জেলা, মহানগর এবং ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা। বিএনপি ঢাকা মহানগরের ৬০টি থানায় এবং তাদের মিত্ররা ৭টি স্পটে মানববন্ধন করবে।
কিন্তু নাম এবং সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব রাজনৈতিক দলের শক্তি-সামর্থ কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির সঙ্গে যে ৩৭টি দল যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে, তাদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়া আর কারও নাম-ধাম-পরিচয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তেমনটি শোনা যায় না। কতগুলো দল আছে, যাদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককেও সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা জোট নেতারাই চেনেন না।
এসব দলের অধিকাংশই মূল দলের খণ্ডিতাংশ। সভাপতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে সাধারণ সম্পাদক দলের কয়েকজনকে নিয়ে আলাদা দল করেছেন অথবা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দলের চতুর্থ সারির কোনো নেতাকে দিয়ে ‘বিকল্প’ দল বানিয়ে রাখা হয়েছে। এদের অধিকাংশেরই নেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন এবং সাংগঠনিক শক্তি বা জনভিত্তিও নেই ‘ওয়ানম্যান শো’ এসব রাজনৈতিক দলের।
গত ১১ জানুয়ারি বিজয়নগরের আল রাজী কমপ্লেক্সের সামনে গণঅবস্থান কর্মসূচিতে ১১দলীয় জোটের মাত্র ৬৫ জন নেতাকর্মী অংশ নেন। তাদের মধ্যে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৪০ জন। বাকি ২৫ জন ফুটপাতে বসে ছিলেন। একইভাবে সাত দল নিয়ে গঠিত ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ ও ১২ দল নিয়ে গঠিত ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’র কর্মসূচিতেও ৪০/৫০ জনের অধিক নেতাকর্মী কখনও দেখা যায় না। এসব দলের নেতারা চড়া গলায় সরকার পতনের আওয়াজ তুললেও সংগঠনিক শক্তি বলতে তাদের কিছু নেই।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে ছোট দলগুলোর প্রাসঙ্গিকতা খুব একটা নেই। বিএনপির সমর্থনে চার জোট ও জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর উল্লেখযোগ্য ভোটারও নেই। সরকার পতনের আন্দোলন সফল করতে হলে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে মাঠে নামাতে হবে, যেটি এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি বিএনপি।
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে এই ছোট দলগুলোর যে প্রাসঙ্গিকতা সেটি আওয়ামী লীগ-বিএনপি তৈরি করেছে। এটা নির্বাচনি রাজনীতির অংশ। বিশেষ করে রাজপথের প্রধান যে বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি বোঝাবার চেষ্টা করে যে, তাদের প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটা সমর্থন রয়েছে। ফলে ছোট দলগুলোর সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে, তাদেরই স্বাগত জানাবে বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতিতে সব দলের শক্তি-সামর্থ এক রকম হয় না। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বড় দল, মাঝারি দল, ছোট দল— সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কারণ, সবারই একটা সমর্থক গোষ্ঠী আছে। দাবি আদায়ের জন্য যুগপৎ আন্দোলনে সেই সমর্থক গোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে।’
তবে এসব নাম ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল নিয়ে বিএনপির পুরোনো মিত্রদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আপত্তি তুলেছেন। যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকা এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম ৩০ দল নিয়ে গঠিত তিন জোটের শক্তি-সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যাদের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, জন সমর্থন নেই, ভোট নেই, তাদের দিয়ে জোট গঠন করে আন্দোল হবে না। যাদের সাংগঠনিক ভিত্তি আছে, ভোট আছে, তাদের নিয়ে আন্দোলন করতে হবে।’
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও বিএনপির মিত্রদের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে উস্মা প্রকাশ করা হয়েছে। দলটির দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো আছে? এসব দলের কোনো গঠনতন্ত্র আছে? এখন তারা কে কী বলল, তারা কী জোট করল— এটা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কি কোনো চিন্তা-ভাবনা করে?’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি নাম্বার (সংখ্যা) দিয়ে কাউকে কি বোকা বানানো সম্ভব? এবং এদের লিডারশিপে যারা আছে তারা কি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, তাদের কি কোনো রাজনৈতিক আদর্শ আছে? কোনো সাংগঠনিক কাঠামো আছে? আমি মনে করি না এ ধরনের একটি বড়সড় তথাকথিত জোট সৃষ্টি করে বিএনপি কারও কাছে কোনো আনুকূল্য পাবে।’
সারাবাংলা/এজেড/এমও