Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আয়নার ভেতর অন্য মানুষ

ওমর ফারুক হিরু, কক্সবাজার প্রতিনিধি
১ এপ্রিল ২০২৩ ১০:৫৯

কক্সবাজার: ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মতো খেলতাম বলে নানা কথা শুনতে হতো। তখন কাউকে বোঝাতে পারিনি এই আচরণের জন্য আমি দায়ী নই। প্রকৃতিগতভাবেই আমি এমন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্লাসের এক সহপাঠীর সঙ্গে মারামারি হয়। ওই সময় স্যারও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, আমি কেন মেয়েদের মতো? সেই থেকে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি’— এসব কথা বলছিলেন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ১৯ বছরের স্বেচ্ছাসেবক আঁখি (তৃতীয় লিঙ্গ)।

বিজ্ঞাপন

আঁখির পরিবারের দেওয়া নাম মোহাম্মদ তাহের। তিনি কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া (৭ নাম্বার ওয়ার্ড) পিটি স্কুল এলাকার ছব্বির আহম্মদের সন্তান।

আঁখি বলেন, ‘স্কুলে যাওয়া বাদ দেওয়ার এক বছর পর পাড়ার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়ে সেজে নেচেছিলাম। পরদিন সকালে সর্দার এসে পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাদেরকে এলাকা ছাড়তে হবে। অপরাধ, আমি মেয়ে সেজে নেচে সমাজের মুখে চুনকালি মেখেছি। ওই সময় মা আমাকে খুব মেরেছিলেন। মারধরের একপর্যায়ে আমার মাথা ফেটে যায়। মাথা ফেটে যাওয়ায় যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তারও বেশি কষ্ট পেয়েছি রক্তের সর্ম্পকের মানুষগুলোর ব্যবহারে। আমি যেন তাদের কাছে অচেনা মানুষ!’

‘এরপর একদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। বেশি অবাক লেগেছিল তখনই, ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় একটা মানুষও আমাকে বাধা দেয়নি। বরং তারা যেন আপদ বিদায় হওয়ায় খুশিই হয়েছে। বাড়ি ছেড়ে একটা দোকানে চাকরি নিই। কিন্তু ওখানেও থাকতে পারছিলাম না, মালিকের নোংরা চরিত্রের কারণে। এরপর ওই দোকান থেকে পালিয়ে আমার জাতের (তৃতীয় লিঙ্গ) মানুষদের সঙ্গে চলে যাই’, বলেন আঁখি।

তৃতীয় লিঙ্গের গুরু মা হিসেবে পরিচিত বৃষ্টি (৩৭)। শহরের আর্দশ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর জলিলের সন্তান তিনি। পরিবারের দেওয়া নাম শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে গুরু মা হলেন সম্মানজনক পদ। আজ সেই অবস্থানে আমি। নিয়ম অনুযায়ী যারা তরুণ, তারা আয়-রোজগার করে গুরু মাদের খাওয়ায়। আর গুরু মা সবার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।’

চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট বৃষ্টি। ১৪ বছর বয়সে পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে তিনি শহরের কলাতলীর ইলিয়াস সদরের পাহাড়ে ৮-১০ জন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী নিয়ে অস্থায়ীভাবে পাহারাদার হিসেবে অবস্থান করছেন।

বিজ্ঞাপন

বৃষ্টি বলেন, ‘আমার বাবা-মা জনতেন আমি তৃতীয় লিঙ্গের। তারা আমাকে খুবই আদর করতেন। কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না যে, তাদের সন্তান তৃতীয় লিঙ্গের। আমার বোন আমাকে সাজিয়ে দিত। ওই দিনগুলো খুব ভাল ছিল, কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন সইল না। ১৪ বছর বয়সে আমার বাবা-মা দুইজনই মারা যান। তারা মারা যাওয়ার পর চিত্র পাল্টে যায়। মা মারা যাওয়ার চারদিন পরই ভাইয়েরা আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। সবার অভিযোগ আমার চলাফেরা কেন মেয়েদের মত? আমার কারণেই নাকি তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। ঘর থেকে বের হয়ে সমুদ্র পাড়ের ঝাউবাগানে এক বৃদ্ধার কাছে আশ্রয় নিই। তাকে মা বলে ডাকতাম না। কিছুদিন পর তার ওখান থেকে আমি আমার দলের লোকদের কাছে চলে যাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছোট বেলাতেই মা-বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমার ভাই-বোনরা আমাকে ঠকাবে। এ জন্য তারা তখনই আমার ভাই-বোনকে আমার প্রাপ্য দুই গন্ডা জায়াগা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাই-বোনেরা সেটা করেনি। দীর্ঘ ১২ বছর পর ২০১৮ সালে সেই জায়গার জন্য নিজ পরিবারের কাছে গেলে পাড়ার সর্দারসহ মিলে আমাকে ঠকায়। সর্দার বলেন, ‘তুমি তো হিজড়া, তুমি এই সমাজে থাকতে পারবে না। জায়গাটা আমাদের কাছে বিক্রি করে দাও। এরপর ওই জায়গার দাম ধরা হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু এই পাঁচ বছরে তারা আমাকে জায়গাও দেয়নি, টাকাও দেয়নি। আমি চেয়েছিলাম অন্তত আমার দলের মানুষগুলো নিয়ে ভাড়া বাসা বা কারও জায়গায় পাহারাদার হিসেবে না থেকে একটি স্থায়ী জায়গায় বসবাস করতে। সেটাও হলো না।’

‘খুবই লজ্জা লাগে যখন দোকানে দোকানে গিয়ে পেটের দায়ে ১০-২০ টাকা চাঁদা চাই। কত কথা শুনতে হয় এই ১০ টাকার জন্য। কেউ বলে তোরা কাজ করতে পারিস না? মরতে পারিস না? আমরাও বলি এতবড় শরীর নিয়ে আর ভিক্ষা করতে চাই না। আমাদের কাজ দেন। কষ্টে করে খাব। আমি এরইমধ্যে কয়েকটা হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন শুরু করেছি। যদি ছোট্ট ঋণ বা সুযোগ পাই তাহলে আমার জনগোষ্ঠি নিয়ে হাঁস-মুরগির খামার বা কৃষিকাজ করে খাব। কারণ আমরা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিরাপদ আশ্রয়স্থান চাই। হাত-পা ছাড়া পঙ্গু শিশুদেরও পরিবারে জায়গা হয় কিন্তু আমাদের হয় না। তাই যে ঘরে এমন সন্তান জন্ম নেবে তাদেরও যেন অন্য দশজন শিশুর মতো বাচাঁর অধিকার দেওয়া হয়, বলেন বৃষ্টি।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পরিচালক (পলিসি এডভোকেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস) ফারহানা জারিফ কানতা জানান, এই মানুষদের প্রতি সহানুভূতির জায়গাটা পরিবার থেকেই আসতে হবে। পরিবারের সচেতনতার মাধ্যমে অন্য শিশুদের মত তাদের বেড়ে উঠার অধিকার নিশ্চিত হবে। তখনই তারা দেশের সম্পদে পরিণত হবে। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারে প্রায় ৪ শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী রয়েছেন।

জেলার সচেতন মহল বলছেন, তাদের (তৃতীয় লিঙ্গ) অবহেলা নয়, সচেতনতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। তখনই দেশ ও জাতির সফলতা নিশ্চিত হবে।

সারাবাংলা/ইআ

তৃতীয় লিঙ্গ

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর