‘৬ মাসের’ এমপি হওয়ার দৌড়ে আওয়ামী লীগের ২৭ জন
২২ মার্চ ২০২৩ ২২:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মহানগরী ও বোয়ালখালী উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ২৭ জন। এর মধ্যে প্রয়াত দুই সাংসদের স্ত্রী, মূল দল আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা থেকে ব্যবসায়ী, প্রবাসী-পেশাজীবীও আছেন।
একাদশ সংসদের মেয়াদ আছে আর ১০ মাসের মতো। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় শূন্য হয়েছে নির্বাচনি আসনটি। তৃতীয় দফায় যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি সর্বোচ্চ ছয় থেকে আট মাসের মতো মেয়াদ পাবেন। এই স্বল্প সময়ের জনপ্রতিনিধি হতেও আগ্রহের কমতি নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে, যাদের অধিকাংশেরই খুব বেশি পরিচিতি নেই এলাকায়।
তবে এলাকার লোকজনের মধ্যে আলোচনা আছে, মেয়াদের শেষ কয়েকমাসের জন্য যিনি এমপি হবেন, তিনিই অনায়াসে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের বৈতরণীও পার হবেন। বিদ্যমান ভোটের পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের টিকিটি যিনি পাবেন, তিনিই যাবেন সংসদে।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ একাংশ) আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮৫। এর মধ্যে ২ লাখ ৪১ হাজার ১৯৮ পুরুষ এবং ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৮৭ নারী।
২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফায় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরীক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর তিনি মারা গেলে চলতি মেয়াদের প্রথম দফায় আসনটি শূন্য হয়। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। তিনি গত ৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন।
নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল এই আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৭ মার্চ। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৯ মার্চ। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ৫ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ৬ এপ্রিল।
গত ২০ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হয়। ২২ মার্চ শেষদিন পর্যন্ত ২৭ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে দফতর থেকে জানানো হয়েছে।
মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সাবেক সদস্য সাইফুল ইসলাম, এস এম কফিল উদ্দীন, মো. হায়দার আলী চৌধুরী, মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও মো. আরশেদুল আলম বাচ্চু, বোয়ালখালী উপজেলা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, উপদেষ্টা মোহাম্মদ জাহেদুল হক ও সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মনছুর আলম, নগর কমিটির কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ, সদস্য বিজয় কুমার চৌধুরী ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আবু তাহের এবং জাতীয় শ্রমিক লীগ চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুল ইসলাম।
এছাড়া নগরীর মোহরা সাংগঠনিক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য আশেক রসুল খান ও সুকুমার চৌধুরী, পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের সদস্য মো. এমরান ও বায়েজিদ বোস্তামি থানা কমিটির সদস্য কফিল উদ্দিন খান। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ রবি, সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল কাদের, সাবেক সহ-সভাপতি এস এম আবুল কালাম ও দক্ষিণ জেলা তাঁতী লীগের সহ-সভাপতি জহুর চৌধুরী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য আহমেদ ফয়সাল চৌধুরী, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-দফতর সম্পাদক মো. মাহাবুব রহমান ও নগর কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি এটিএম আলী রিয়াজ খান মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
সাবেক সাংসদ প্রয়াত মোছলেম উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শিরিন আহমেদ এবং একই আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত মঈনউদ্দিন খান বাদলের স্ত্রী চান্দগাঁও ওয়ার্ডের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিনা খান মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
তবে মোছলেম উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে মনোনয়নের প্রত্যাশায় যারা সরব, তারা হলেন- এস এম আবুল কালাম, আবদুচ ছালাম, শিরিন আহমেদ, সেলিনা খান, মোহাম্মদ আবদুল কাদের, আরশেদুল আলম বাচ্চু, মনোয়ার হোসেন, সুকুমার চৌধুরী এবং বিজয় কুমার চৌধুরী।
শুরু থেকেই আ জ ম নাছির উদ্দীনের নাম জোরেশোরে আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেননি। বিজয় কুমার চৌধুরী ও নোমান আল মাহমুদ তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পেশায় প্রকৌশলী বিজয় কুমার চৌধুরী ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও তিনি হেরে যান। উপ-নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি এলাকায় সরব হয়েছেন। সেক্ষেত্রে নোমান আল মাহমুদের নির্বাচনকেন্দ্রিক দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।
মোহরার বাসিন্দা সুকুমার চৌধুরী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সংগঠনে এতদিন নেতৃত্ব দিয়ে এলেও উপ-নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। তার ছবিসহ পোস্টারে নির্বাচনি এলাকা ছেয়ে গেছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক মনোয়ার হোসেন যুক্তরাজ্যে থাকেন। আশির দশকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। পরিণত বয়সে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রায় তিন দশক ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে এসে সভা-সেমিনার করেন।
মনোয়ন প্রত্যাশী মনোয়ার হোসেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘আমি বহু বছর বিদেশে কাটিয়েছি, কিন্তু এখন আমি আমার দেশের মাটির জন্য কিছু করতে চাই। সেজন্য আমি আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বঞ্চিত এলাকা বোয়ালখালী। আমি এ ভূমির জন্য বিশেষ কিছু করতে চাই এবং আমি করব। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আমার নাম না দিলে আমি নির্বাচনে লড়ব না এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচনে দাঁড়াব না।’
বর্ষীয়ান রাজনীতিক মঈনউদ্দিন খান বাদলের মৃত্যুর পর সহধর্মিণী সেলিনা খান উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। স্বামীর গড়া দল জাসদ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি মনোনয়ন পাননি।
জানতে চাইলে সেলিনা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবা সারাজীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। আমিও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। আমার স্বামী জাসদ করলেও আমি কোনোদিন মশাল মার্কায় ভোট দিইনি। আমি সবসময় নৌকায় ভোট দিয়েছি। বাদল সাহেবকে তিন বার ভোট দিয়ে এমপি বানিয়েছিলেন জনগণ। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদটা উনি শেষ করতে পারেননি। উনার অনেক স্বপ্ন ছিল, আমি সেগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। গত উপ-নির্বাচনে আমি মনোনয়ন না পেলেও এলাকা ছেড়ে যাইনি। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে এমপি হতে চাই।’
বাদলের আসনের এমপি হয়েছিলেন মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। তার সহধর্মিণী শিরিন আহমেদও বলছেন, স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য তিনি এমপি হতে চান। তিনি সত্তরের দশকে ছাত্রলীগের নেত্রী ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি শেষে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন।
শিরিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ছিল। কিন্তু আমার স্বামী একজন হোলটাইমার পলিটিশিয়ান হওয়ায় আমি সংসারের জন্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসি। কিন্তু রাজনীতি থেকে আমি কখনো হারিয়ে যাইনি। নির্বাচনি এলাকার উন্নয়নে তিনি অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন। নিয়তির লিখন, সেই পরিকল্পনা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। আমি মোছলেম সাহেবের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। এলাকার মানুষের পাশে থাকতে চাই।’
নগরকন্দ্রিক রাজনীতিতে জড়িত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু এবারই প্রথম কোনো নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তিনি প্রয়াত রাজনীতিক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির পাশাপাশি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আরশেদুল আলম বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন স্মার্ট তরুণ নেতৃত্ব। সেই বিবেচনায় আমি দলের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে আমরা মহিউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছি। আমি বঙ্গবন্ধু আদর্শের কর্মী, জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী। আমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের পরীক্ষিত কর্মী। আশা করি মনোনয়ন পাব।’
২০০৮ সাল থেকে তিন দফা সংসদ নির্বাচনে এবং সাংসদ বাদলের মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন আবদুচ ছালাম। তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান। আবদুচ ছালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০০৮ সালে এবং ২০১৪ সালে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু মহাজোটের স্বার্থে বাদল সাহেবকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এবার দল আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। আমি মনোনয়ন পেলে অবশ্যই দলকে জয় উপহার দিতে পারব।’
বোয়ালখালীর বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান এস এম আবুল কালাম পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘসময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তবে জিততে পারেননি। দল আবারও সুযোগ দেবে বলে মনে করেন সত্তরোর্ধ এস এম আবুল কালাম।
আবদুল কাদের সুজন ১৯৮৪ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ ও বোয়ালখালী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। চটগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন।
আবদুল কাদের সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন ছাত্রলীগ করি, তখন ছিল বৈরি সময়। এরশাদ আর খালেদা জিয়ার সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে গ্রামগঞ্জে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছি। ছাত্রজীবন শেষে সাব রেজিস্ট্রার পদে চাকরি হয়েছিল। ইউসিবিএল ব্যাংকে চাকরি হয়েছিল। সার্বক্ষণিক রাজনীতি করব বলে চাকরিতে যোগ দিইনি। ৩৮ বছর ধরে দলের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। কোনোদিন দলের নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। আশা করি, দল এবার আমাকে মূল্যায়ন করবে।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম