Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শুধু প্রদর্শন নয়, গবেষণাও করছে গণহত্যা জাদুঘর

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৬ মার্চ ২০২৩ ১৮:০৭

ঢাকা: ১৯৭১। যে ইতিহাস বিজয়ের, যে ইতিহাস গর্বের আর স্বাধীনতার। আবার একইসঙ্গে এটি বিশ্বের অন্যতম নৃশংসতম গণহত্যারও ইতিহাস। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে বিজয়ের গর্বের ইতিহাস যতটি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার ইতিহাস যেন ততটা গুরুত্ব পায়নি। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, শহিদদের নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায় অনেকে। প্রশ্ন তোলে শহিদদের সংখ্যা আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ নিয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর যে হত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল তার ইতিহাস তুলে ধরতে গড়ে তোলা হয়েছে গণহত্যা জাদুঘর। জাদুঘর মানেই ইতিহাস সংরক্ষণ করলেও তারা ১৯৭১ সালের গণহত্যা নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনার ময়লাপোতা এলাকার শেরেবাংলা রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে এই জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে জাদুঘরের দ্বিতীয় পর্যায়ে নগরীর সোনাডাঙ্গায় একটি দ্বিতল ভবনে ভাড়া নিয়ে জাদুঘরটির কাজ চলছে। এটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় যারা এই বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণহত্যা জাদুঘর স্থাপনের জন্য একটি জমি দিয়েছেন। জাতীয় জাদুঘর এই জমিতে একটি অত্যাধুনিক জাদুঘর ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন।

বিজ্ঞাপন

জাদুঘর স্থাপনা ও পরিচালনায় রয়েছে ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড। বোর্ডের সভাপতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন, সহ-সভাপতি শিল্পী হাশেম খান ও সাধারণ সম্পাদক ড. চৌধুরী শহিদ কাদের। আর জাদুঘরের কিউরেটর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান।

গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গবেষণার মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত তাদের গবেষণায় দেখা গেছে— সারাদেশে ৩৪ জেলায় ১৪ হাজার ৪৫২টি স্থানে গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সারাদেশে গণকবর পাওয়া গেছে এক হাজার ৪৮টি। নির্যাতনকেন্দ্র এক হাজার ২৭টি, বধ্যভূমি সাতশ ৫৯টি। অর্থাৎ মোট ১৭ হাজার ২৮৬টি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রতি বর্গমাইলে সংগঠিত পাঁচ থেকে দশ হাজার, নারী নির্যাতন পাঁচ লাখের বেশি। এ ছাড়া মোট শহিদ তিরিশ লাখ বলা হলেও শরণার্থী শিবিরে আরও পাঁচ লাখ মৃত্যু ধরলে মোট শহিদ সংখ্যা পঁয়ত্রিশ লাখ ছড়িয়ে যাবে।’

শুধু বাংলাদেশই নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। দেশজুড়ে সংগঠিত গণহত্যার নানা নিদর্শন প্রদর্শনের পাশাপাশি গণহত্যার সঠিক ইতিহাস সংগ্রহেও কাজ করছে এই জাদুঘর। বধ্যভূমি জরিপ, গণহত্যা সংগঠিত হওয়া স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণ, প্রতিটি গণহত্যার ওপর গণহত্যা নির্ঘণ্ট নামে আলাদা আলাদা বই প্রকাশ, প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আন্তর্জাতিক কনফারেন্স, স্মারক বক্তৃতা, লাইব্রেরিসহ নানা কাজ করছে দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘরটি।

জাদুঘরের ট্রাস্টি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. শহীদ কাদির বলেন, ‘গণহত্যা জাদুঘরটি খুলনায় স্থাপনের অন্যতম কারণ খুলনার চুকনগরে ১৯৭১ সালের সবচেয়ে বড় ও নৃশংস গণহত্যাটি চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এই জাদুঘরে খুলনাসহ সারাদেশের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে স্মারক, ছবি, চিত্রকর্ম, বই ইত্যাদির মাধ্যমে। খুলনার প্লাটিনাম জুটমিলে বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হতো। পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতনের চিহ্ন হিসেবে আমরা সেই পোড়া বয়লারের একটি ধ্বংসাবশেষ এই জাদুঘরে এনে রেখেছি। এ ছাড়াও যুদ্ধের সময় যেসব টর্চার সেলে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর নির্যাতন করত তেমন একটি প্রতীকী টর্চার সেল এখানে আমত্রা স্থাপন করেছি, নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরতে। এখানে মাত্র কয়েকটা মাথার খুলি প্রদর্শন করা হলেও দেশের প্রায় সব প্রান্তের বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা মাথার খুলি ও হাড়গোড় আমাদের সংগ্রহে আছে।’

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গণহত্যার সম্পর্ক বোঝাতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শনও এখানে রেখেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় তার সামনে থাকা বুলেট মাইক্রোফোন যা দেশের আর কোথাও পাবেন না। ২৬ মার্চ ভারতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে সে সময়ের জনপ্রিয় বক মার্কা সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে স্ত্রী জোহরাকে লেখা তাজউদ্দীন আহমদের দুই লাইনের চিঠিও রয়েছে এখানে।

এ ছাড়াও শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদুল্লা কায়সারের দুটি টাই ও ডায়েরি, বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীন আহমেদের কোট, সেলিনা পারভীনের কলম ও শাড়ি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পাঞ্জাবি, পায়জামা ও পাণ্ডুলিপি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লেখা বই, ডা. আলীম চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ড, ল্যাম্প, ডেন্টাল টুলকিট ও ডায়েরি আছে জাদুঘরে। শহিদ পরিবারের সদস্যরা এগুলো জাদুঘরে দান করেছেন।

এছাড়া আমরা জাদুঘরের পাশাপাশি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম আমরা পরিচালনা করছি। ‘গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ শিরোনামের এই গবেষণার আওতায় আমরা গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে গণহত্যার বড় একটি দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পেরেছি। এ ছাড়া আমাদের গণহত্যা মিউজিয়ামের একটি অংশ রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে কাজ করছি। এর আওতায় আমরা গণহত্যার ওপর লেখা প্রায় দেড়শ বই ইংরেজিতে অনুবাদ করব। আমরা এরইমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ে যোগাযোগ করেছি। সেখানে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘জেনোসাইড স্টাডিজ’ নামে একটি কোর্স চালু হতে যাচ্ছে।

জাদুঘরের ডেপুটি পরিচালক রোকনুজ্জামান বাবুল জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত গণহত্যার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে শুধুই গণহত্যা নিয়ে এই জাদুঘর তৈরি করা হয়। আর সেই ইতিহাস তুলে ধরতে আমরা জাদুঘরে আর্টিফ্যাক্ট প্রদর্শন ছাড়াও সারাবছরই বিশেষ করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসকে কেন্দ্র করে নানা সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন করে থাকি। গণহত্যা নিয়ে বছরে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার করি, ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করে থাকি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও অন্যান্য আগ্রহীদের জন্য গণহত্যার ইতিহাস জানাতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও আয়োজন করে থাকে গণহত্যা জাদুঘর। একেকবার একেক জেলায় এই প্রশিক্ষণ চলে। চলতি মাসেই খুলনা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধকে জানো’ শিরোনামে একটি বিশেষ আয়োজন করে তারা। এতে দশ দিনে তিন হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

এ ছাড়াও সারাদেশে কোথায় কোথায় গণহত্যা হয়েছে, বধ্যভূমি আছে সেসব স্থানের অবস্থান নিয়ে জিপিএস ম্যাপিংয়ের কাজ চলছে।

জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই আছে ৮ হাজারের ওপর। বর্তমানে ১২০টি গণহত্যা বিষয়ক স্মৃতি স্মারক প্রদর্শিত হলেও সংগ্রহে রয়েছে আরও বেশি। গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর ছবি প্রায় ১০০ টি, পেইন্টিং ৫৫টি, ও ভাস্কর্য রয়েছে ৩০টি।

সেমিনার সিম্পোজিয়াম ছাড়াও প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন মানুষ আসেন জাদুঘর ঘুরে দেখতে। জাতীয় দিবস ও ছুটির দিন সংখ্যাটি কয়েকগুণ বেড়ে যায় বলে জানান জাদুঘরের সহকারী পরিচালক।

ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সোমবার বাদে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং নভেম্বর থেকে জানুয়ারি সময়ে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। প্রতি শুক্রবার এটি বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরে প্রবেশ ফি ১০ টাকা আর শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচ টাকা।

সারাবাংলা/আরএফ/একে

গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর