২৭ মার্চ ১৯৭১: বিশ্ব গণমাধ্যম জুড়ে শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ
২৬ মার্চ ২০২৩ ২৩:০৯
ঢাকা: ২৭ মার্চ ১৯৭১। বিশ্ব বিমডিয়া গুরুত্বের সঙ্গে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’ ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।’
দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে…। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তার এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। শিরোনাম লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’ য়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণ।’ এ পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছেপেছিল প্রথম পাতায়।
ভারতের নয়াদিল্লি থেকে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক ডেভিড লোসাক লেখন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভয়ানক রকমের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম এই রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়।’
তিনি আরও লেখেন, ‘গত রাতে বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যোন্নয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দমনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ভারী অস্ত্রসহ ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে পশ্চিম পাকিস্তান। ঢাকার সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ মুজিবসহ তার পাঁচ ঘনিষ্ঠ সহচরকে রাতের আঁধারে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে কারফিউ জারি হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বেসমারিক অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। চারদিকে লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।’
অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য এইজ ‘ঢাকা ব্রেকস উইথ পাকিস্তান’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপে। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েট প্রেসের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদনের শিরোনামের পরই বড় বড় হরফে দুই লাইনে উল্লেখ করা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান ২৬ মার্চ নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছে যে তারা আর করাচি প্রশাসনের সঙ্গে নেই।’
দ্য এইজের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতের রেডিও প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে গতকাল বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে ওই ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণকে উৎসাহ দেওয়া হয়। বেতার কেন্দ্রটি নিজেদেরকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে অভিহিত করেছে।’
ব্রিটেনের দ্য লন্ডন টাইমসের শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিবুর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করায় প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে।’
দ্য বোস্টন গ্লোব ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হতে গৃহযুদ্ধ শুরু’ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী নেতা শেখ মুজিবুর গ্রেফতার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এছাড়া আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রচার করা হয় এদিন। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস হেরাল্ডের একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বেঙ্গলি ইনডিপেনডেন্স ডিক্লার্ড বাই মুজিব।’
এদিন সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রমনা কালীমন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এদের বেশিরভাগই ছিল বাঙালি ইপিআর সদস্য। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করে সামরিক কর্তৃপক্ষ।
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে লিখেছেন, নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের সামনে পৌঁছেই রুমী হঠাৎ ‘ও গড!’ বলে ব্রেক কষে ফেলল। সামনেই পুরো কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই হয়ে রয়েছে। এখনো কিছু কিছু ধোঁয়া উঠছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মানুষও পুড়েছে।’ রুমী জোরে গাড়ি চালিয়ে, ‘আম্মা তাকায়ো না ওদিকে’ বলে ডান দিকে মিরপুর রোডে মোড় নিল।’
হাসপাতালের আউটডোরে গেটে ঢোকার আগে রুমী আরেকবার ‘ও গড!’ বলে ব্রেক কষে ফেলল। পাশেই শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো গোলার আঘাতে ভেঙে দুমড়ে মুখ থুবড়ে রয়েছে। আমার দু’চোখ পানিতে ভরে গেল। একি করেছে ওরা!’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেন এবং বাঙালিদের আশ্রয় দিতে সীমান্ত খুলে দেন। আকাশবাণীতে সীমান্ত খুলে দেওয়ার খবর জানার পর জনস্রোত ধাবিত হয় সীমান্ত অভিমুখে।
ঢাকায় টানা ৩৪ ঘণ্টার হত্যাকাণ্ড শেষ করে পাকিস্তানের সেনারা ব্যারাকে ফেরে। পাকিস্তানের কোনো মিডিয়া বর্বরতার কথা প্রকাশ হয়নি। আর ঢাকায় কোনো পত্রিকাই প্রকাশ হয়নি।
সারাবাংলা/এজেড/একে