।।মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।
ঢাকা : এসএসসির মতন একটি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই নিজেদের স্কুলে স্কুলে হুমড়ি খেয়ে ফলাফল দেখতে ভিড় করবে শিক্ষার্থীরা, সাফল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫ পেয়ে সবাই হাসিমুখে ভিক্টরি চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তুলছে – এসব দৃশ্য দেশের অধিকাংশ স্কুলের জন্য নয়। বাস্তবতা হলো এখানকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যই এসব দৃশ্য শুধুই রূপকথার গল্প।
রাজধানীর দুটো মাঝারি মানের পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সিদ্ধেশ্বরী বালক বিদ্যালয় ও উইলস লিটল ফ্লাওয়ার। এই স্কুল দুটির পাশেই নামকরা দুইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – ভিকারুননিসা নূন ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল।
প্রতিবছরই ফল প্রকাশের উৎসব মানেই এসব নামকরা স্কুলে গণমাধ্যম কর্মীদের ছুটোছুটি। সব ফটোগ্রাফাররা তখন ঐ পাড়ায় নানা ভঙ্গিমায় বিজয়ী বেশে শিক্ষার্থীরা আনন্দ উল্লাসের ছবি তুলতে ব্যস্ত। খুব স্বাভাবিক, কেই বা কবে সাধারণের গল্প বলেছিল?
তবে সিদ্ধেশ্বরী বালক বিদ্যালয় বেশকয়েক বছর ধরেই আছে সংবাদের শিরোনামে। না, পরীক্ষার ফল ভালো করার জন্য নয়। জাতীয় কোনো পুরস্কার জয়ের জন্যেও নয়। তারা পত্রিকার শিরোনামে ছিল অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করার জন্য। গত ২৫ এপ্রিলও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) এক সংবাদ সম্মেলনে করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান স্কুলটি আছে দুর্বৃত্তদের কবলে। এর অবকাঠামো ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা করা হয়। স্কুলের শিক্ষকদের অস্ত্র হাতে ধমকিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সাল থেকে বিদ্যালয়টি শিরোনামে স্থান করে নিয়েছিল তাদের খেলার মাঠটি দখল হয়ে যাওয়ার জন্য। ঢাকার বুকে জ্বলজ্বল নক্ষত্র মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের প্রদীপের নিচের অন্ধকার এই সিদ্ধেশ্বরী বালক বিদ্যালয়। তাদের মাঠই লিজ নিয়ে করা হয়েছে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি বুঝে পায়নি মাঠের দখল। এখনও চলছে তাদের যুদ্ধ।
ফল প্রকাশে উচ্ছ্বাস জানতে দুপুরে সারাবাংলার প্রতিবেদক যখন এই স্কুলটিতে তখন উচ্ছ্বাস দূরে থাক, সবাই তটস্থ। কী যেন কী হয়! দারোয়ানের কড়া প্রহরা পার করে পৌঁছানো গেল স্কুলেরগণ্ডিতে। খুব অল্প সংখ্যক কিছু শিক্ষার্থী এসেছে স্কুলে। এখানে কোনো ড্রাম নেই, কোনো নাচও নেই। মোট শিক্ষার্থী একশ জনেরও কম, তার মধ্যে জিপিএ-৫পেয়েছে মাত্র চারজন। বাণিজ্য বিভাগে ফেল করেছে ছয়জন।
জিপিএ-৫ বা ফেল কোনো কিছু নিয়েই প্রতিক্রিয়া নেই অধ্যক্ষ শেখ ফরিদুজ্জামানের। ফল নিয়ে সন্তুষ্ট কি-না প্রশ্নের জবাবে গলা ধরে আসে তার। বলেন, কীভাবে স্কুলটা টিকে আছে তা ভেবেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়।
জানান, গত বছর স্কুলে পাশের হার ছিল শতভাগ। এ বছর টিকে থাকার যুদ্ধে সেই অবস্থানের অবনতি হয়েছে। অভিযোগ করেন, অল্প বৃষ্টি হলে এখনও স্কুলের সামনে পানি জমে থাকে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে পারে না । সামনের পথটা এখনও ভাঙা চোরা। মাঠ থেকে নির্মাণ সামগ্রী গিয়েছে, যায়নি তার ক্ষত।
স্কুলের শিক্ষার্থীরাও মাঝারি মানের। তাদের সামাজিক অবস্থান মাঝারি, স্বপ্ন মাঝারি, চেষ্টা মাঝারি, শুধু টিকে থাকতে পেরেই খুব আনন্দিত তারা। ফলাফল নিয়ে তাদের খুব উচ্ছ্বাস যেমন নেই, দুঃখও নেই। স্বস্তি, উৎরে যাওয়ার।
আলোচিত আরেক স্কুল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার। সম্প্রতি স্কুলের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তোপে পরে ছাত্রত্ব হারিয়েছে কয়েকজন। অভিযোগ আছে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীরা অস্ত্র পর্যন্ত নিয়ে আসে। কয়েক বছর আগে বেতন বাড়ানোর অভিযোগে আন্দোলনও করেছেন অভিভাবকরা। এসএসসির ফল প্রকাশের পরে সারাবাংলা জানতে চায় কেমন করেছে স্কুলটি?
বাণিজ্য বিভাগে ২২ জন সহ স্কুলের মোট ফেলের সংখ্যা এবার ২৭ । এরপরেও খুব সন্তুষ্ট স্কুল শাখা প্রধান মো. মশিউর রহমান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, সারাদেশেই যখন পাশের হার ৭৭ শতাংশ আমরা তো তাও ৯০ শতাংশের উপরে পাশ করেছি।
তার কাছেই জানা যায়, যে ব্যাচটি এ বছর এসএসসি দিল ৭ মাস পর্যন্ত তারা ক্লাস করতে পারেনি। গত বছর মার্চেই শেষ হয়ে যায় তাদের ক্লাস। কারণ স্কুল ভবন ভেঙে নতুন করে গড়া হচ্ছে। এ সময়টিতে তাদের শুধু পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
মো. মশিউর অভিযোগ করেন, এ বছর ২৭ জন পরীক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল, অভিভাবকদের চাপে তাদের মূল পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হয়। বোর্ডে গিয়ে তারাই খারাপ করে।
এ স্কুলটিতেও নেই ফল প্রকাশের উচ্ছ্বাস। শিক্ষার্থীরা অনেকেই আসেনি ফল নিতে। মোবাইলে জেনে নিয়েছে ফল।
মো. মশিউর বলেন, আমরা খুব করে চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানটির মান উন্নত করতে। শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে। হয়তো সামনে গিয়ে আবার উন্নত করতে পারব।
সারাবাংলা/এমএ/জেডএফ