‘দেশের সম্পদ বেচে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি করি না’
২৭ মার্চ ২০২৩ ১৮:৪৯
ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকারে আসি। তখন আমরা অনেকগুলো কাজ করে বাংলাদেশকে একটা মর্যাদার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০১ সালে আমরা সরকারে আসতে পারিনি। কেন পারিনি? আমি রাজি হলে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধাই হতো না। কিন্তু দেশের সম্পদ বেচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে ক্ষমতায় যাবে— ওই রাজনীতি আমি করি না।
সোমবার (২৭ মার্চ) দুপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনায় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দেশবাসীসহ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন কৃত্রিমভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হলো। যখন মানুষের ওপর একের পর এক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছিল। তখন কিন্তু কেউ ক্ষমতা নেওয়ার চিন্তা করেনি। কিন্তু যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এনে, একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় চরম আঘাতটা নিয়ে আসে। কারণ, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এই ঘুণেধরা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ বিনির্মাণ করবেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে তৃণমূল মানুষকে ক্ষমতাসীন করবেন। মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি যে কাজগুলো করেছিলেন সেটিকে ধ্বংস করার জন্যই ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এরপর ২১ বছর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনাকে বিকৃত করা হয়েছে।’
১৫ আগস্টের পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করা এবং ক্ষমতার লেবাস পরে প্রথমে উত্তরণ। এরপর রাজনীতিবিদদের গালি দিয়ে ক্ষমতা দখল। তারপর সেই লেবাস খুলে রাজনীতিবিদ হয়ে গিয়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে দল গঠনের কালচারটাই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে। আজ সেই অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারীদের হাতে তৈরি করা সংগঠন নাকি গণতন্ত্র চায়? যাদের জন্ম হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে, মিলিটারি ডিকটেটরের পকেট থেকে। অবৈধ দখলদারী- এটা তো আমাদের কথা না; এটি তো উচ্চ আদালতই বলে দিয়েছেন। জিয়া-এরশাদ সকলের ক্ষমতা দখল ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ।’
জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলের তুলনামূলক প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা নালিশ করে বেড়ায়। তাদের ওপরে নাকি খুব অত্যাচার হচ্ছে? আরে অত্যাচার তো আমরা করি নাই। অত্যাচার করেছে তো ওই বিএনপি-জামায়াত জোট। জিয়াউর রহমান এসে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার থেকে শুরু করে প্রায় কয়েক হাজার মানুষকে নির্বিচারে ফাঁসি দিয়েছে, গুলি করছে। পরিবারগুলো তাদের লাশও পায়নি। বিমানবাহিনীর প্রায় ৫৬৫ জন সৈনিক অফিসারকে নির্বিচারে হত্যা করেছে ১৯৭৭ সালে।’
জিয়াউর রহমানের আমলে গুম-খুনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘জিয়ার আমলে সাদা মাইক্রোবাসে যাকে ওঠাতো সে আর কোনোদিন মায়ের কোলে ফিরে আসেনি। জিয়াউর রহমান একইভাবেই ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা তো তাদের মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছি। আওয়ামী লীগকে তো কোনোদিন মাঠেই নামতে দেয়নি। হাত কেটেছে, পা কেটেছে, চোখ তুলে নিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বাড়িঘর দখল করে রাতারাতি পুকুর কেটে সেখানে আবার কলাগাছ পুঁতেছে। সারা বাংলাদেশে তারা তাণ্ডব চালিয়েছে। এখন তারা আসে গণতন্ত্রের ছবক দিতে? তাদের ওপর নাকি অত্যাচার? ওরা আমাদের সঙ্গে যা করেছে তার যদি এক ভাগও আমরা করি তাহলে ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা তো সে পথে যাইনি। আমরা তো প্রতিশোধ নিতে যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘তারা জাতির পিতার হত্যাকারীকে ইনডেমনিটি দিয়ে সংসদে বসিয়েছে। জিয়াউর রহমান তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। এরশাদ তাদের দল গঠন করতে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করতে দিয়েছে কর্নেল ফারুককে। খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট চুরি করে রশিদ আর হুদাকে পার্লামেন্টে এনে লিডার অপ দ্য অপজিশনের সিটে বসিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকারের কথা বলে? আমরা যারা ১৫ আগস্ট আপনজন হারিয়েছি আমাদের কি মানবাধিকারের কোনো সুযোগ নেই? আমি তো বিচার চাইতে পারিনি। তারা আজকে কথা বলে। এত কথা কোথা থেকে বলে? আর দেশের ভেতরে নয়, বাইরে গিয়ে নালিশ ও কান্না করাই তাদের চরিত্র। তারা মনে করে ওপর থেকে এসে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। বাংলার মানুষ এখন অনেক সজাগ, অনেক সচেতন।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমরা ২১ বছর ১৯৯৬ সালে সরকারে আসি। তখন আমরা অনেকগুলো কাজ করে বাংলাদেশকে একটা মর্যাদার জায়গায় নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু ২০০১ সালে আমরা সরকারে আসতে পারি নাই। কেন পারিনি? আমি রাজি হলে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি ক্ষমতায় থাকাতে কোনো অসুবিধাই হতো না। কিন্তু দেশের সম্পদ বেচে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে ক্ষমতায় যাবে- ওই রাজনীতি আমি করি না।’
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ক্ষমতায় যেতে পারিনি। আমাদের নেতাকর্মীদের খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেইসঙ্গে দেশের মানুষও একটা তুলনা করতে পেরেছে যে, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতে কীভাবে লুটপাট হয়, অত্যাচার হয়, দুর্নীতি হয়, সন্ত্রাস হয়। আর কীভাবে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে পাঁচশ জায়গায় বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, বাংলা ভাই সৃষ্টিসহ অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশ পাচার করার কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ জবাব দিয়েছিল। যে কারণে তিনশ সিটের মধ্যে বিএনপিসহ ২০ দলীয় ঐক্যজোট মাত্র ২৯টা সিট পেয়েছিল।’ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপির কৌশলের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের জন্য কাজ করি, মানুষের কল্যাণে কাজ করি। আমরা ওয়াদা করেছিলাম বাংলাদেশের প্রতিঘর আলোকিত করব। আজ শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছি। এখানে প্রশ্ন ওঠে। বিদ্যুৎ দুর্নীতি খোঁজে? দুর্নীতি করলে কি এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়। খালেদা জিয়া সরকার দুর্নীতি করেছিল বলেই তো বিশ্বব্যাংক বিদ্যুতের টাকাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেটা আবার ধরা পড়েছে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।’
ডিজিটাল বাংলাদেশ, বেসরকারি খাতে গণমাধ্যম, সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেওয়া জিনিস ব্যবহার করেই আমাদের বিরুদ্ধেই বদনাম করবে। আর বদনাম করে বলবে, কথা বলতে দেওয়া হয় না। নানা অপপ্রচার তো চালিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা। রমজান মাসে মানুষের যাতে কষ্ট না হয় আমরা সেই ব্যবস্থা করছি। আর সেখানে তারা আন্দোলন করবে। আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে যৌথভাবে সভা পরিচালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম। আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাম্বাসেডর মোহাম্মদ জমির, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম, পারভীন জামান কল্পনা, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবির প্রমুখ।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম