গাইবান্ধা উপনির্বাচন: অনিয়মে জড়িতদের শাস্তি হয়নি ৪ মাসেও
২৮ মার্চ ২০২৩ ২৩:০৯
ঢাকা: গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়মে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত ১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলন করে অনিয়মে জড়িত থাকা ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের পাঁচজন উপ-পরিদর্শকসহ ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। সিইসি‘র ওই ঘোষণার চার মাস পার হলেও এখনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে আরও ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইসির বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা চিঠি দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করে ইসি। কিন্তু শাস্তিতো দূরের কথা, বেশকিছু নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইসির চিঠির কোনো জবাবই দেয়নি। তবে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করা হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষকের ইনক্রিমেন্ট এক বছরের জন্য বন্ধের কথা বলা হয়েছে। তবে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ইসি কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের পাঁচ উপ-পরিদর্শক, একজন সহকারী উপপরিদর্শকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের শাস্তির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। এ ব্যাপারে ইসিও কিছু জানে না। এমনকি এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে পুনরায় চিঠি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
শাস্তির ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১৩৩ জনকে চিঠি দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ৪০টি চিঠির জবাব পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কাউকে শাস্তি দিতে চিঠি লিখি তখন বিভাগীয় নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সেভাবেই হয়তো ওরা ব্যবস্থা নিচ্ছে, অথবা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা কোনো সাড়া পাইনি। আমরা দ্বিতীয়বার তাদের চিঠি দেব। সেখানে আমরা তাদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেব। এছাড়াও অন্য কোনো বিকল্প আমাদের আছে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের জানানো হবে।’
এদিকে, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অভিযুক্ত রিটার্নিং অফিসারকে (নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা) নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশনের (ইটিআই) পরিচালক করা হয়েছে। অথচ গাইবান্ধা নির্বাচনের জন্য ইসি তাকে অভিযুক্ত করেছিল। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিইসি বলেন, ‘তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেজন্য তাকে হয়তো সেই দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে অন্য জায়গায় সংযুক্ত করা হয়েছে।’
অন্যদিকে, নির্বাচনের কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩৩ জনকে চিঠি দেওয়া হলেও ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিধীন।’ এই ৪০ জন কারা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এদের বেশিরভাগ শিক্ষক।’
নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের পাঁচজন উপ-পরিদর্শকসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা হয়েছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না তা এখনো জানায়নি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।’
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে বরখাস্তসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। ওই সময় বলা হয়, কমিশন গাইবান্ধা নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইন অনুসারে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছে। পাশাপাশি রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়া অন্য সংস্থা বা বিভাগ থেকে নির্বাচনে দায়িত্বে আসা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্ব স্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শাস্তির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে এক মাসের মধ্যে ইসিকে জানাতে বলা হয়েছে। যারা বিভিন্ন প্রার্থীদের এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের শনাক্ত করে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণের পর সিইসি প্রথমে ৫০টি কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে। এর পর রিটার্নিং কর্মকর্তাও একটি কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেন। পরে ভোটগ্রহণের যৌক্তিকতা না থাকায় পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেয় ইসি। নির্বাচনের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ওই দিনই নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ইসির তদন্ত কমিটি ৬৮৫ জনের শুনানি করে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পায়। সেই তদন্তের আলোকে ১৩৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
ইসির তদন্তে বলা হয়েছে, ১২৫টি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, সেসব কর্মকর্তার নামের তালিকা সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। দায়িত্বপালনে অবহেলা তথা অসদাচারণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে জানাবে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চার মাসেও অনেক প্রতিষ্ঠান ইসির চিঠির কোনো জবাব দেয়নি।
ইসির তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কেন্দ্র নম্বর ২ (তরুণ কুমার, এসআই. গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৪ (মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৯ (মো. আনিছুর রহমান, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৬২ (কনক রঞ্জন বর্মন, এসআই সাদুল্যাপুর থানা) ও কেন্দ্র নম্বর ১০৫ (মো. দুলাল হোসেন, এএসআই, আটোয়ারী থানা, পঞ্চগড়) এর পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে -দায়িত্বপালনে অবহেলা তথা অসদাচারণের কারণে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে পত্র দেয় কমিশন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে জানানোরে নির্দেশ থাকলেও মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়নি।
এছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাশক (সার্বিক) সুশান্ত কুমার সাহার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৫ অনুসারে অসাদাচরণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এক মাসের মধ্যে জানাতে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, তদন্তে রিটানিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের (আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজশাহী) বিরুদ্ধে ১৯৯১ এর ধারা ৫ অনুযায়ী দায়িত্বপালনে অবহেলার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তাকে শাস্তি না দিয়ে আরও ভালো জায়গায় পরিচালক পদে বদলি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম