প্রস্তুতি ছাড়াই চিকিৎসকদের বৈকালিক সেবা দেওয়ার ঘোষণা মন্ত্রীর
২৯ মার্চ ২০২৩ ১৫:২২
ঢাকা: দেশের ১০টি জেলা ও ২০টি উপজেলা হাসপাতালে ৩০ মার্চ থেকে চিকিৎসকরা নির্ধারিত ফি নিয়ে সেবা দেবেন রোগীদের— এমন ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। একইসঙ্গে চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারণ করা ফি’র বিষয়েও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি কোন কোন হাসপাতালে এই সেবা চালু হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এই সেবা পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করার কথা জানালেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) থেকে এই সেবা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা জানানো হলেও এই প্রতিবেদন লেখা অবধি খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাই জানেন না ডায়াগনস্টিক সেবার পাশাপাশি ক্লিনিক্যাল ও প্যারা ক্লিনিক্যাল বিভিন্ন টেস্টের ফি কত হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত নীতিমালার কিছু বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল নির্ধারণের জন্য। সেই তালিকা ২৯ মার্চের মধ্যে চূড়ান্ত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বাকি যে কাজ সেগুলো এই সময়ের মধ্যেই শেষ করার বিষয়ে আশাবাদী।
প্রস্তুতি ছাড়াই তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা এলো কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা কোনো উত্তর দেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষণা দেওয়া হঠকারিতা। মূলত সবাই নিজের অবস্থান ধরে রেখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভালো সাজার চেষ্টাটাই করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে না। আর তাই পাইলট প্রজেক্ট হলেও যেভাবে তারিখ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তা অপরিপক্বতা। একইভাবে একটা ভালো উদ্যোগ যদি শুধুমাত্র পরিকল্পনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে তবে সেটার প্রভাব পড়তে পারে ভবিষ্যতের জন্য নেওয়া নতুন প্রকল্পগুলোতেও।
সোমবার (২৭ মার্চ) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে বৈকালিক চেম্বার বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিবসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিএমএ, স্বাচিপের নেতাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরাও।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, একাধিক ব্যক্তি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া বৈকালিক চেম্বারে সেবা শুরু করে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানান। একইসঙ্গে সময়সূচি নিয়েও কয়েকটি প্রস্তাব আসে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেবা বাড়ানো যায় কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা হয়। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে সেবা নেওয়াটা কতটুকু সঠিক হবে এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়।
তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জানান, কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় সমালোচনা হলেও সফল হয়েছেন তিনি। আর তাই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের বৈকালিক চেম্বারের সিদ্ধান্তেও তিনি আশাবাদী।
বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে ৩০ মার্চ সেবা চালু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান। এ সময় তিনি চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ফি ও আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় জানালেও কোন কোন প্রতিষ্ঠানে এ সেবা দেওয়া হবে তা নিয়ে কিছু জানাননি। কারণ কোনো কিছুই আসলে চূড়ান্ত করা হয়নি, যা তিনি জানাতে পারবেন। তবে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিং শেষ হওয়ার পরে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন হাসপাতালের নাম চূড়ান্ত করার জন্য। এরপরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বৈঠক করলেও বুধবার (২৯ মার্চ) সকাল পর্যন্ত কোনো নাম চূড়ান্ত হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নীতিমালা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু করা হতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো বিবেচনা করে জানানো হবে কী কী সেবা কিভাবে দেওয়া হবে। এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদফতর নাম চূড়ান্ত করলে তখন বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।’
তবে ৩০ মার্চ শুরুর ঘোষণা দিলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই অবগত না হওয়ার কারণে এই প্রকল্প নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন একাধিক অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও।
তবে সরকারি চাকরি বিধিমালার কারণে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাননি কেউ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তেই দেশের স্বনামধন্য একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক বলেন, ‘সরকার নির্দেশ দিলে ২৪ ঘণ্টাও দায়িত্ব পালন করতে হবে আমাদের। এটাই সরকারি চাকরির নিয়ম। কিন্তু যে সেবাদানের কথা বলা হচ্ছে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই পরিষ্কার নয়। কোথায় হবে সে বিষয়েও কিছু জানানো হয়নি। আর যে সময়সীমার কথা বলা হচ্ছে সেখানে হয়তোবা তিন ঘণ্টা আমি যদি রোগী দেখি তবে এক হাজার ২০০ টাকার মতো পাব। এখানে টাকার কথাটাও বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু এই সময়ে রোগীদের আসলে কী কী সেবা দেওয়া যাবে তা যদি এখন পর্যন্ত না জানি তবে সেবা কিভাবে দেওয়া যাবে?’
তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক চেম্বার নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা নিয়ে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই আবার প্রক্রিয়ার বিষয়ে না জানায় দোটানার মাঝে রয়েছেন। একইভাবে অন্য পেশায় না থাকলেও শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে আলাদাভাবে সেবা দিতে গিয়ে কর্মঘণ্টা বাড়ানো হবে কিনা তা নিয়েও ভাবছেন কেউ কেউ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারিতে একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের সেবা নিতে রোগীকে দিতে হয় এক হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে এই টাকা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তারা জানান, যারা একদম নতুন চিকিৎসক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হচ্ছেন তাদের জন্য একটা ভালো সুযোগ হতে পারে এ ধরণের চেম্বার। কারণ তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিচিতি বাড়ানোর মাধ্যমও হতে পারে এই বিশেষায়িত সেবা। কিন্তু কোনো ধরণের প্রস্তুতি ছাড়া আসলে সেবা দেওয়ার ঘোষণাটা তরুণদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বলে একটা প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। কিন্তু যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া সেটা করা কতটুকু সঠিক তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে আমি বৈঠকেও জানিয়েছি। এর উপর সরকারি প্রতিষ্ঠানেই টাকার বিনিময়ে রোগীদের সেবা পাওয়ার বিষয়টি সমাজের বাকিরা কিভাবে দেখবে সেটাও বিবেচনা করার বিষয়। রোগী ও চিকিৎসকদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে এমন সিদ্ধান্ত।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সারাদেশের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই বলেন। তিনি স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের জন্যেও অনেক কিছু বলেছেন। তার কতগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটার পরিসংখ্যান কী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কেউ দিতে পারবে? এই যে নতুন একটা সেবা মুখে বলে চালু করে দিচ্ছে তার জন্য কী সংশ্লিষ্ট কারো সঙ্গে বৈঠক করেছে? ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মন্ত্রণালয়ের সভায় জানিয়েছি এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য আরেকটু সময় দরকার ছিল। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ও এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটা রাউন্ড টেবিল বৈঠক করা যেত। শুধু মন্ত্রণালয় যদি একা এই নীতিমালা ইমপ্লিমেন্ট করতে যায় তাহলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।’
তবে এ সেবা চালু ও রোগীদের উপকার পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। এর ফলে রোগীদের সেবা নেওয়ার পরিধি আরও বাড়বে। একইসঙ্গে চিকিৎসকরাও প্র্যাকটিসের সুযোগ পাবে।’
তবে কোন কোন হাসপাতালে এই সেবা শুরু হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাচিপ সভাপতি বলেন, সেটা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর এটা নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি খুব দ্রুতই তারা সেটা চূড়ান্ত করবেন।
চিকিৎসকরা অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করবেন কিনা সে বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘চিকিৎসকসহ সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি সেবা দানের জন্য সরকারের প্রয়োজন হলে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে হবে। এটিই নিয়ম। সেক্ষেত্রে সকল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারের ভাবনা সরকারের ভালো উদ্যোগ। তবে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয়। রাজধানীর বাইরে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানের পদ খালি। এ দেশে প্রচুর মানুষ, প্রচুর রোগী। হাসপাতালগুলোতে বারান্দায় রোগী রাখতে হয়। অবকাঠামো ঠিক না করে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে পুরো চিকিৎসাসেবা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিএসএমএমইউ, বারডেম, হার্ট ফাউন্ডেশনে এ ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে সক্ষমতা আছে। অন্যান্য হাসপাতালে নিয়মিত রোগী ও তার স্বজনদের বসার জায়গা নেই। প্রস্রাব-পায়খানা করার ব্যবস্থা নেই। নতুন করে অবকাঠামো ও প্যাথলজি সুবিধা এবং লোকবল না বাড়িয়ে এ ধরনের উদ্যোগে লাভ হবে না।’
চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতালে চেম্বারে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার সুবিধা এবং অসুবিধা প্রসঙ্গে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী।
তিনি বলেন, ‘নীতিগতভাবে এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত। এতে সরকারি অবকাঠামোর যে সীমিত ব্যবহার, তার থেকে অনেক বেশি ব্যবহার করা যাবে। জনগণ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলভ মূল্যে একটা নৈতিক পরিবেশে সেবা পাবে, এতে একটা বড় সুবিধার বিষয় আছে। তবে এর সঙ্গে আরও কিছু সমন্বিত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংশয় রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা সেবা দেবেন, তখন সেখানে ডায়াগনস্টিক ফ্যাসিলিটিসহ অন্যান্য চিকিৎসা অবকাঠামো যদি না থাকে তাহলে রোগীর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে হলে অনৈতিকতার ঘাঁটি হয়ে যায় কিনা? আবার সেখানে যেহেতু ডুয়েল প্রাকটিস থাকবে, এমন না যে যারা ‘ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ করবে তাদের বাইরে প্রাকটিস বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ইন্সটিটিউশনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকবে, তেমনটাও না। হয়তো তারা রোটেশনাল ডিউটি করবে, যেমনটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে।’
ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ‘চিকিৎসকরা কিছুক্ষণ ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস করবে, আবার কিছুক্ষণ বাইরে প্রাকটিস করবে। সেক্ষেত্রে এটেন্ডেন্ট থেকে শুরু করে অ্যাসিস্ট্যান্টদের যে চেইন রয়েছে, তাদের মাধ্যমে রোগীদের ডায়ভার্ট করার জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় কিনা, যদি যথাযথ রেগুলেশন এবং নিয়ন্ত্রণ না থাকে। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সুবিধা না থাকলে বাধ্য হয়ে রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা বাইরে থেকে করে আনতে হবে। তাই সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বিষয়টা কতটুকু সফল হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।’
ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস প্রথমে পাইলটিং হওয়া উচিত যেখানে মেডিকেল শিক্ষা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যেন চিকিৎসা এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দিতে পারেন। আমাদের সময় শিক্ষক সন্ধ্যাকালীন একটা রাউন্ড দিতেন। দিনে পাবলিক রিলেশন, পরীক্ষা, মিটিং নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যাকালীন রাউন্ডে আমরা বেশি শিখতে পারতাম।
তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস থাকে, তাহলে সেটা যদি এভাবে করা যায় যে, প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে পাইলট আকারে হবে, তারপর জেলা উপজেলা পর্যায়ে সামর্থ্য বৃদ্ধি করে বিস্তৃত করা হবে। আর ডুয়েল প্রাকটিস চালু রেখে, ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস কতটা সফল হবে, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যদি ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস করতে হয়, তাহলে যথাযথ প্রণোদনা এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে যারা ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসে রাজি হবে, তাদের ফুল টাইম ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসে রাখতে হবে। ডুয়েল প্রাকটিসে নৈতিকতার প্রশ্ন চলে আসে এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করাও খুব কঠিন হবে।’
এর আগে, সোমবার (২৭ মার্চ) সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘সরকারি চিকিৎসকদের বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ সংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
জাহিদ মালেক বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে সেবা দেন। তারপর সিনিয়র চিকিৎসকরা হাসপাতালে থাকেন না। এরপরেও অনেক মানুষের চিকিৎসা পরামর্শ ও টেস্টের প্রয়োজন হয়। এতে বিকেলে বহু মানুষ চিকিৎসা নিতে না পেরে বাইরে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দেখান। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ‘ফি’ বেশি হওয়ায় দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’
চিকিৎসক না থাকায় অনেক মানুষের কষ্ট হয়, আমরা সেই কষ্ট লাঘবের জন্য এই দ্বিতীয় শিফট চালু করেছি বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে আলোচনা করে ৩০ মার্চ থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করব। চিকিৎসকরা প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস এখানে করবেন সরকারি হাসপাতালে। প্রথমে আমরা কয়েকটি জেলা হাসপাতালে এই কার্যক্রম শুরু করব। ১০টি জেলা হাসপাতালে এবং ২০টি উপজেলায় এই কার্যক্রম শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম কেমন চলছে তা আমরা দেখব। সেখানে যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, আমরা সেটা সংশোধন করে পর্যায়ক্রমে ৫০০টি উপজেলা এবং ৬৪ জেলায় বাস্তবায়ন করব। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে চেম্বার করবেন। তাদের এই সেবা দেওয়ার জন্য সম্মানী নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সম্মানীর একটি অংশ চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং আরেকটি অংশ হাসপাতাল পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসাসেবা পরামর্শের পাশাপাশি ছোটখাটো সার্জারি, ডায়াগনস্টিক/ক্লিনিক্যাল/ প্যারা-ক্লিনিক্যাল টেস্টসহ বিভিন্ন রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেগুলোর জন্যেও মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। সেখান থেকেও খরচের অংশ পাবে হাসপাতাল। আপাতত আমরা এভাবেই কাজটি শুরু করতে যাচ্ছি।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘এই সেবার জন্য একজন অধ্যাপকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন, সেবার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা এবং হাসপাতাল পাবে ৫০ টাকা। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক বা সিনিয়র কনসালটেন্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। এর মাঝে চিকিৎসক পাবেন ৩০০ টাকা। সহকারী অধ্যাপক বা জুনিয়র কনসালটেন্ট, বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা, যার ২০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘এমবিবিএস বা বিডিএস বা সমমনা ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৫০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। বাকি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কাটা হবে এবং চিকিৎসকদের সহায়তাকারীরা পাবেন। এক্ষেত্রে নার্স ও টেকনিশিয়ানরাও সপ্তাহে দু’দিন করে কাজ করবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ ছাড়া লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে ছোট সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি ৮০০ টাকা এবং সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি এক হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দুই-তিন মাস যাবত ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা ছিল, এ টার্মের শুরুতেই ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করা হোক। কিন্তু ডেঙ্গু ও করোনার কারণে তা আমরা শুরু করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমরা আস্তে আস্তে সব জেলা ও উপজেলায় শুরু করব।’
সরকারি চিকিৎসকদের সপ্তাহে কয়দিন করে ডিউটি থাকবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, একজন চিকিৎসককে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা করে সেবা দিতে হবে। তবে এই সেবা যাতে মানুষ সপ্তাহে অন্তত ছয় দিন নিশ্চিত করে পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগে, ২২ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন চিকিৎসক পেশাজীবী সংগঠনসহ, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘ইনস্টিটিউশনাল প্রাকটিস বিষয়ক একটি জরুরি সভায়’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে আগামী ১ মার্চ থেকে নিজ কর্মস্থলেই সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন।
সারাবাংলা/এসবি/ইআ/আইই