।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজধানীর জনবহুল এলাকায় বেশ বড় আয়তন নিয়ে বিদ্যালয় দু’টির অবস্থান হলেও কোনো কালেই মিডিয়ার নজরে আসেনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে কোনো গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এসেছে— এমন কোনো তথ্য জানা নেই স্কুল সংশ্লিষ্ট কারোর। হয়তো ফলাফল ভালো হয় না বলেই মিডিয়াকর্মীদের উপস্থিতি নেই স্কুল দু’টিতে। আজ রোববার (৬ মে) এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পরও তেমনই দেখা গেল, উদযাপনে নেই তেমন কোনো আড়ম্বর। তবে তুলনামূলকভাবে বালিকা শাখায় ফল ভালো হওয়ায় বালক শাখার তুলনায় সেখানে উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি।
বলছিলাম রাজধানীর রামপুরা এলাকার বেশ পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একরামুন্নেছা বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা। পৃথক ক্যাম্পাস হলেও একই নামে হওয়ায় বালক কিংবা বালিকার পরিচয় ছাপিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টির পরিচিতি ‘একরামুন্নেছা স্কুল’ নামেই। এর মধ্যে একরামুন্নেছা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ১৯৬৫ সালে, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৬৯ সালে।

এসএসসি পরীক্ষার ফলের দিনও এমনই ফাঁকা দেখা গেল একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়
রামপুরা টেলিভিশন ভবনের বিপরীত দিকে সড়কের পাশেই অবস্থিত রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রোববার ২০১৮ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, মাঠটিতে কয়েকটি ছেলে ক্রিকেট খেলছে। কয়েকটি কক্ষে চলছে ক্লাস। মূল ফটকসহ ভবনগুলোর বারান্দায় হাতেগোনা কয়েকটি ছেলে ঘোরাফেরা করছে, না হয় দলবেঁধে বসে রয়েছে। দুয়েকজন শিক্ষককে দেখা গেল ফলাফল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
দুপুর দেড়টার দিকে ফলাফলের একটি কপি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গেলেন একজন শিক্ষক। ফলাফল কেমন হলো— জানতে চাইলে ওই শিক্ষকের সোজাসাপ্টা উত্তর ,‘ভালো না।’ তারপর উপস্থিত ছাত্রদের রোল নম্বর জিজ্ঞাসা করে করে ফলাফল বলে যেতে থাকলেন তিনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আরো একজন শিক্ষক ফলাফল ঘোষণা করছেন। দেখা গেল, প্রায় সবারই ফলাফল জিপিএ ৩ থেকে ৪-এর ঘরে।

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরীক্ষার ফল ঘোষণা করছেন একজন শিক্ষক
এই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোহসীন হোসেন পেয়েছে জিপিএ ৩.৮৩। শিক্ষকের কাছ থেকে ফলাফল জেনেই বেশ উচ্চস্বরেই বলে ওঠে, ‘আলহামদুলিল্লাহ। যা হইছে ভালোই হইছে।’
প্রধান শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার ফল নিয়ে কথা হলো তার কক্ষেই। সারাবাংলাকে তিনি বললেন, স্কুলটি থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ১৩৮ জন। এর মধ্যে অকৃতকার্য হয়েছে মাত্র একজন। তাই পাশের হার ৯৯.২৮ ভাগ। উত্তীর্ণদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ছয় জন। এরা সবাই বিজ্ঞান বিভাগের। এ বিভাগ থেকে পরীক্ষার্থী ছিল ৬১ জন।
প্রধান শিক্ষক আরো জানালেন, মানবিক শাখায় এই স্কুলটি থেকে চার জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের সবাই পাস করেছে। আর ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭৩ শিক্ষার্থীর একজন কেবল অকৃতকার্য হয়েছে। তবে মানবিক বা ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে কেউ জিপিএ ৫ পায়নি।
স্কুলের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কৃতকার্য হওয়া মোট ১৩৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ ৪-এর ঘরে ৭৪ জন, ৩-এর ঘরে ৫৩ জন এবং ২-এর ঘরে ৪ জনের ফল।

প্রধান শিক্ষকের সাথে স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পাওয়া ৬ শিক্ষার্থীর একজন আল-আমীন
প্রধান শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বিদ্যালয়ের এক হাজার ছাত্রের মধ্যে ৭০ ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে প্রান্তিক শ্রেণির পরিবার থেকে আসা। বাকিরা কোনোমতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়েন। এসব শিক্ষার্থী বাসায় সেভাবে পড়ার পরিবেশ পায় না। শিক্ষা উপকরণ জোগাতে এদের বাবা-মাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। এরা এ ফলেই খুশি।
তার কথার সত্যতা মিললো অভিভাবক সাবের আক্তারের সঙ্গে কথা বলে। তার ছেলে সালমান এই স্কুল থেকে এবার জিপিএ ৩.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, স্কুলের এক হাজার টাকা কোচিং ফি আর মাসিক ফি জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। এর বাইরে বাসায় ছেলেকে কোনো প্রাইভেট টিউটর দিতে পারিনি। যে ফল করেছে, তাতেই আমরা খুশি।
স্কুলের সার্বিক ফলাফলে সন্তুষ্টি জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমরা মাটি ঘষে সোনা বানাই। ছাত্রদের বেসিক গড়ার ওপর গুরুত্ব দেই। যে কারণে প্রতিবছরই এখান থেকে পাস করে অনেকেই নটরডেমের মতো কলেজেও ভর্তি হয়। জিপিএ-৫ আমাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। আমরা চাই শিক্ষার সবগুলো জায়গায় আমাদের ছাত্ররা যোগ্যতর হয়ে গড়ে উঠুক।
আলাপচারিতার মধ্যেই এই স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পাওয়া ছয় জনের একজন আল-আমীন এসে প্রধান শিক্ষকের পা ছুঁয়ে ছালাম করে। প্রধান শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম যখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তাদের দু’জনের চোখেই অশ্রু, তবে তা আনন্দের।
আল-আমীন জানায়, শিক্ষকদের প্রচেষ্টাতেই এমন ফলাফল তার। চোখ-মুখে আনন্দের যে ধারা, তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না আল-আমীন জীবনের সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত পার করছে।

বালক শাখার দুইশ’ গজ দূরেই অবস্থিত একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের গলি থেকে ২’শ গজ দূরেই একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। অবকাঠামোগতভাবে বালকের চেয়ে পিছিয়ে বালিকারা। তবে ফলাফলে এগিয়ে কয়েকগুণ। বালক ক্যাম্পাস যেখানে সুনশান-চুপচাপ, সেখানে বালিকা ক্যাম্পাসের আনন্দধ্বনি দূর থেকে কানে বাজছে। গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই চোখে পড়লো পুরো মাঠে বালিকাদের উচ্ছ্বাস। ঢাকের তালে তালে সে আনন্দ পুরো ক্যাম্পাস অনেকটা উজ্জীবিত। নেই গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত, টিভি বা সংবাদপত্রের ক্যামেরাপারসন বা ফটোগ্রাফার। তাতে কী, শিক্ষার্থীদের হাতের মোবাইল ফোনগুলোই হয়ে উঠেছে ক্যামেরা, তাতে বন্দি হচ্ছে আনন্দের সব মুহূর্ত।
এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনেয়ারা। ১০ মাস আগে এখানে এসেছেন। এরই মধ্যে স্কুলের অনেক শিক্ষকের মুখেই তার প্রশংসা শোনা গেল। কেউ কেউ বললেন, আমাদের প্রধান শিক্ষক অনেক চৌকষ। তার সুপারভিশনে এবারের ফলাফল আগের বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে। এবার সবখানে যখন জিপিএ ৫ কমেছে, সেখানে আমাদের এখানে বেড়েছে। এ আনন্দ আমাদের সবার।

এসএসসি পরীক্ষার ফলের দিনেও বালক শাখা চুপচাপ, সে তুলনায় বালিকা শাখায় ছিল বেশ উচ্ছ্বাসের আমেজ
প্রধান শিক্ষক হোসনেয়ারার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আরো কয়েকজন শিক্ষক বসে আছেন। সবার মুখেই হাসি। অন্যদিনের চেয়ে আজকের দিনে তার কক্ষের জৌলুস অনেক বেশি।
প্রধান শিক্ষক হোসনেয়ারা জানান, এবার তার স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৮১ জন। একজন বাদে সবাই পাস করেছে। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৯ জন। গত বছর জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩২।

বালিকা শাখার প্রধান শিক্ষক বলছেন, তারা স্কুলে ফলে সন্তুষ্ট
প্রধান শিক্ষকের মতে, এ বছর জিপিএ পাওয়ার হারটি স্বাভাবিক। শিক্ষার একটি ন্যূনতম মান থাকা উচিত। মাঝখানে সেটি ছিল না। এখন সেটি ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। তার মতে, এবার পরীক্ষার হলে কড়াকড়ি, উত্তরপত্রে ‘সহানুভূতি’ নম্বর না দেওয়ায় জিপিএ-৫ কমেছে। এটি পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য ইতিবাচক।
হোসনেয়ারা সারাবাংলা’কে বলেন, এটি গরিবের স্কুল। গ্রামের ভিটেমাটিহারা যে মানুষগুলো জীবিকার সন্ধানে এই শহরে আসেন, তাদের মেয়েরাও এখানে পড়ে। বাবা-মা পড়ালেখা জানে না। অনেক মেয়ে আছে যাদের ক্লাসে আনতেই আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এমন ফলাফল কোনোভাবেই কম অর্জন নয়। তারপরও আমাদের প্রত্যাশা অনেক। সে অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনাও আছে। আশা করি, আগামী বছর আমরা আরো ভালো ফল উপহার দিতে পারব।
সারাবাংলা/এমএস/টিআর/