মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ছিল তিন ধরনের ভূমিকা
৩১ মার্চ ২০২৩ ১০:১৯
ঢাকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দুঃসাহসিক বীরত্বপূর্ণ বিশেষ অবদান রয়েছে। ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। একাত্তরের ৪ মার্চ মাদারবাড়ী এলাকায় অস্ত্রাগার দখল করে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র সংগ্রহ করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধে এই তিন সংগঠনের নেতাকর্মীরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে একদিকে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে চিকিৎসা সেবা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্না-বান্নার কাজও করেছেন।
তবে দেশের অধিকাংশ চিনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করতে যাওয়ার পথে কিংবা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে পিকিংপন্থীরা হত্যা করেছে। চিনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো মুক্তিযুদ্ধে তিন ধরনের ভূমিকা পালন করে। এদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আরেকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে আখ্যা দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনী- দুই বাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে। অপর অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। চিনের বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তান, তাই তারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে অংশ নেয়।
তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা কমরেড মণি সিংহ মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। বামধারার একাধিক নেতার সাথে কথা বলে এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা বিভিন্ন বই থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বর্বর আক্রমণ শুরু করলে গণচিন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করে। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো বাণীতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সুখসমৃদ্ধি পাকিস্তানের অখণ্ডতার উপর নির্ভরশীল। যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে তারা হলো মুষ্টিমেয় লোক।’
কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে দলটির কয়েকজন নেতা সারাবাংলাকে বলেন, দেশের অধিকাংশ চিনপন্থী কমিউনিস্টরা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে কিছু কিছু চিনপন্থী কমিউনিস্ট এ যুদ্ধের যথার্থ মূল্যায়ন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তবে একথা সত্য অধিকাংশ চিনপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধকে ‘রাশিয়ার সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে মনে করেছিলেন। ফলে পাকিস্তানিবাহিনী বর্বর আক্রমণ শুরু করলে গণচিন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টি যৌথভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোতে স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে। পার্বত্য জেলা পর্যায়ের এসব কাজের মূল নেতৃত্বে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, আবু বকর সিদ্দিক, দেওয়ান মো. আলী, আবু তাহের মাসুদ, শাহ মোহাম্মদ খোরশেদুল ইসলাম, তপন দত্ত প্রমুখ শ্রমিক নেতা। ন্যাপ নেতাদের মধ্যে ছিলেন আহমেদুর রহমান আজমী, পুর্ণেন্দু দস্তিদার, নুরুন্নবী, আবদুল হাই, শফিউল আলম, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী, সৈয়দ আবুল ফজল মাইজভান্ডারী, জহিরুল হক, বখতেয়ার নোমানী, অমল নাথ প্রমুখ। পুর্ণেন্দু কানুনগো, আবদুস সাত্তার, অনঙ্গ সেন, ধীরেন দাস, কালিপ্রদ চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। আবুল হায়াত ও মোহাম্মদ মুসা ছিলেন কৃষক নেতা। আর ছাত্র নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুবুল হক, গিয়াস উদ্দীন আহমেদ, শামসুজ্জামান হীরা, আবদুল আওয়াল, শাহ আলম (সিপিবির বর্তমান সভাপতি), বালাগাত উল্লাহ, আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ ইউসুফ, আলাউদ্দীন প্রমুখ।
কক্সবাজারে এ তিন সংগঠনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন সুরেশ সেন, সুভাষ দাশ, রাখাল সরকার প্রমুখ। রাঙামাটিতে নেতৃত্ব দেন জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, সুনীল কান্তি দে, বাবুল দে, মেমা চিং লিলি, আবদুর রশীদ, দিলীপ দে, আবুল কাশেম প্রমুখ। সব শ্রেণির মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন তারা।
আগরতলায় ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা ক্র্যাফস হোস্টেলে থাকতেন। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন কমরেড মণি সিংহ, মোজাফ্ফর আহমদ, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জি, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিউর রহমান, শেখর দত্ত, আবদুল হাদী প্রমুখ। চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী, খোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ।
নারী নেত্রী বেগম মুসতারী শফি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মোহাম্মদ বেলালও এই হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন। কমান্ডার আবদুর রউফ ও ড. আনিসুজ্জামান এখানে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।
আগরতলার কর্তাবাড়িতে রিক্রুটিং সেন্টার ও অফিস গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ থেকে পৌঁছানো কর্মী ও সংগঠকরা এখানে আশ্রয় পেতেন। পরে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কিছু প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্য থেকে গেরিলাযোদ্ধা বাছাই করা হতো। বাছাইকৃতদের পাঠানো হতো আসামের তেজপুর ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা আবার আগরতলায় ফিরে আসতেন এবং সেখান থেকেই দেশের ভেতর তাদের ইন্ডাকশনের ব্যবস্থা করা হতো। কমিউনিস্ট পার্টির মতিউর রহমান ও শেখর দত্ত এই দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন এবং ক্যাম্প পরিচালনা করতেন ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক।
পরবর্তীতে বড় দুয়ারিতে আরও একটি ক্যাম্প তৈরি করা হয়, যার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মুনজুরুল আহসান খান, ইয়াফেস ওসমান, নিজামুদ্দিন ও মাহবুবুল হক। এখানে নতুন রিক্রুটদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এই ক্যাম্প থেকেই গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশের ভেতর ইন্ডাকশনরে সময় ১১ নভেম্বর নিজামউদ্দীন আজাদসহ ৯ জন গেরিলা কুমিল্লার বেতিয়ারায় শহীদ হন।
১১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র পুনরায় দখলে নেয়। পটিয়ায় বোমাবর্ষণের পর শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ ও আহসান উল্লাহ চৌধুরী আগরতলায় চলে যান। ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী পুর্ণেন্দু দস্তিদার ৯ মে ডিজিটলংয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নিরাপত্তার কথা ভেবে চট্টগ্রামের দক্ষিণের আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে কর্মী-সমর্থকরা পরিবার-পরিজনকে পটিয়া-বোয়ালখালী-বেতাগী-বাগোয়ান-আন্ধারমানিক-রাউজান-ফাটকছড়ি-রামগড় হয়ে ভারতের সাবরুম সীমান্তে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রাউজানে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর কর্মীদের কারণে ওই পথে পাঠানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় বখতেয়ার নোমানী, মাহবুবুল হক, গিয়াস উদ্দিন আহমদ ও শাহ আলমের সমন্বয়ে গঠিত চারজনের একটি অগ্রবর্তী দল হানাদার অধিকৃত চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে মিরসরাই-বুড়বুড়িয়া ঘাট-বড় লস্কর হাট-কালীদহ-পীরবক্স মুন্সীর হাট-ফুলগাজী-বিলোনিয়া হয়ে আগরতলা পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তাঁদের এই সফল অভিযানের ফলে এই রুটই পরে আগরতলা যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। বখতেয়ার নোমানী, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ নেতাদের এই পথ দিয়ে আগরতলায় পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অধিকাংশ চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। তবে কয়েকটি চিনপন্থী দল যুদ্ধের যথার্থ মূল্যায়ন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আবার কয়েকটি দল মুক্তিযুদ্ধকে “রাশিয়ার সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্রের” অংশ বলে মনে করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী বর্বর আক্রমণ শুরু করলে গণচিন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় গণহত্যা শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে)-এর নেতৃত্বে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির এক গোপন বৈঠকে সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহা একটি দলিল উত্থাপন করেন।
দলিলে বলা হয়, ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে লড়াই করে পূর্ব পাকিস্তানের যে পৃথক জাতীয় বৈশিষ্ট্য উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সেই পৃথক জাতীয় সত্তাকে ধ্বংস করার জন্য বাঙালি জাতির উপর আক্রমণ চালিয়েছে। কাজেই এটা হল জাতীয় সংগ্রাম এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার এ সংগ্রামকে জনযুদ্ধে পরিণত করতে হবে।
অপরদিকে আবদুল হক, অজয় ভট্টাচার্য এবং শরদিন্দু দস্তিদার তোয়াহা-দস্তিদারের ওই থিসিসের প্রতিবাদ করে পৃথক একটি দলিল উত্থাপন করেন। এই দলিলে তারা বলেন, ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি বুর্জোয়া ও ক্ষমতালোভী পূর্ব পাকিস্তানি উঠতি পূঁজিপতি সামন্তবাদী বুর্জোয়া এই দুই শক্তি সাম্রাজ্যবাদীদের উস্কানিতে পূর্ব পাকিস্তানের পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে উপনীত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির উদ্দেশ্য হলো পূর্ব পাকিস্তানের উপবিনেশবাদী অবস্থা টিকিয়ে রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতালোভীদের উদ্দেশ্য হলো এখানকার আধা-ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী অর্থনৈতিক নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা। এই দলিলে তারা মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা প্রত্যাশিদের মধ্যে সংঘটিত ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
চিনের অনুসারী এই দলটি তখন প্রতিবিপ্লবী গৃহযুদ্ধ বলতে দ্বিধা করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে) দেশের অভ্যন্তরেই ‘লাল ফৌজ’ গঠন করে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করে এবং দেশের কয়েকটি অঞ্চল মুক্ত করে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পার্টির নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কর্মীদের ব্যক্তিগত নেতৃত্বে মুক্ত অঞ্চল ও সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায় এবং অবশিষ্টরা জনগণের মধ্যে আত্মগোপন করে। এক পর্যায়ে হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানিবাহিনীর কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করে। এভাবে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে)-এর নেতা নজরুল ইসলাম ও অমল সেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। সেখানে তারা ‘কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন। তারা পিকিংপন্থী অন্যান্য উপদলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ১ জুন ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ নামে একটি যৌথ কমিটি গঠন করেন। সমন্বয় কমিটির অন্য রাজনৈতিক দল, উপদলগুলি হলো: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি (জাফর-রনো-মেনন), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন-বাসার), নাসিম আলীর হাতিয়ার গ্রুপ, কৃষক শ্রমিক কর্মী সংঘ (ডা. দাহার), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদি।
চিনপন্থী কমিউনিস্টদের মধ্যে মওলানা ভাসানী সমর্থকরা ২৫ মার্চ গঠন করেন “কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। এই কমিটিতে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকরব খান রনো, আবুদল মান্নান ভূঁইয়া ও রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধকালে এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতে যান। তবে এই অংশের অন্যতম নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দেশত্যাগ না করে নিজের এলাকা নরসিংদীর শিবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
এই দলটি পশ্চাদপসরণকারী বাঙালি সেনা, ইপিআর সদস্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং পাকিস্তানিবাহিনীকে পরাস্ত করে অস্ত্র সংগ্রহ করে। তাদের অন্যতম বড় যুদ্ধ ছিল মে মাসে পটিয়া ব্রিজের যুদ্ধ। তাতে ইদ্রিস নামে এক সাহসী কিশোর নিহত হন। মান্নান ভূঁইয়া ভারতবিরোধিতার জন্য খ্যাত ছিলেন। ফলে ১৯৭১ সালের শেষের দিকে এ এলাকায় অভিযানকারী মুজিব বাহিনীর একটি অংশের ওপর তাকে হত্যা করার নির্দেশ ছিল। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের এই অংশ সে নির্দেশ কার্যকর করেনি। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিবপুর অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাস হানাদার বাহিনীর কর্তৃত্ব মুক্ত ছিল।
চিনপন্থী কমিউনিস্টদের এই অংশ পরে “বাংলাদেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করেন। এর প্রধান হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই সময়ে তাদের কর্মকৌশল ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা না করা এবং দরকার হলে সহযোগিতা করা। ভারতে অবস্থানকালে তারা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আমরা’ শীর্ষক এক দলিল প্রচার করেন। এই দলিলে তারা সামগ্রিকভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থিত করেন। দলিলে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর সাথে ‘নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন (প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য), ও রাজনীতিকে অক্ষুণ্ন রাখিয়া একশতবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া যায়।’ দলিলে বলা হয়, ‘এমনকি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদবিরোধী সংগ্রামেও আওয়ামী লীগের একাংশকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলিয়া আমরা মনে করি। কারণ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে বাঙালি বুর্জোয়ার একাংশ’ বিপ্লবের পক্ষে আসবে।’ এখানে দেখানো হয়, ‘আওয়ামী লীগ ও মুক্তিফৌজকে এক মনে করা সঠিক হইবে না। …তাই মুক্তিফৌজকে সাধারণ বুর্জোয়া সেনাবাহিনী বলিয়া মনে করা মারাত্মক ভুল হইবে।…তাই মুক্তিফৌজের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করা এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। …আমাদের উদ্দেশ্য হইল এই যুদ্ধকে প্রকৃত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করা।’ বলা হয়, ‘মুক্তিফৌজের সঙ্গে যৌথ অ্যাকশনে আমরা সর্বদাই সচেষ্ট হইব।
১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সাহিত্যিক আবুল ফজলের নেতৃত্বে লালদীঘিতে শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধ সংঘ স্বাধীনতার পক্ষে সমাবেশের আয়োজন করে। এর নেপথ্যে কাজ করেছে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। ওই সময়ে চট্টগ্রামের নারীসমাজকে সংগঠিত করার কাজেও এ তিন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম শাখা। ১৮ মার্চ চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে মহিলা পরিষদ স্বাধীনতার পক্ষে নারী সমাবেশের আয়োজন করে, সেখানে কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
২৩ মার্চ চট্টগ্রাম হোস্টেলের উত্তর পাশে প্যারেড ময়দানে যে বিশাল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ হয়, সেটার আয়োজনেও ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিউন নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা প্রসঙ্গে মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, পিকিংপন্থি কয়েকটি কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল। তবে পিকিংপন্থি রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, কাজী জাফরদের গ্রুপ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং স্বাধীনতার প্রত্যেকটি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
পিকিংপন্থিদের হক ও তোহা গ্রুপটি স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। এই গ্রুপটি স্বাধীনতার পরও তাদের পার্টির নাম পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি রাখে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছ থেকে টাকা এনে চলতো।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতা সারাবাংলাকে আরও বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করে। অনেককে মেরেও ফেলেছে। কেন মেরে ফেলা হতো বোঝা যায়নি। তবে একটি কথা স্মরণে আছে নূর আলীকে (দৈনিক আমাদের সময় ও হোটেল শেরাটনের মালিক) মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পের খাবার অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া হত। এর প্রতিবাদ করেছিলেন নূর আলী। নূর আলী ছাত্রলীগ করতেন। একদিন রাতে নূর আলী ও সোবহানকে মেরে ফেলার পদক্ষেপ নেয়। এই ঘটনা টের পেয়ে নূর আলী ও সোবাহান ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ইয়ূথ ক্যাম্পে আমাদের কাছে আসেন। যারা নূর আলী ও সোবাহনকে মেরে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছিল তারা ছাত্রলীগের লোক ছিল।
তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ডাক্তার ও নার্সের ভূমিকা পালন করেছে। ফৌজিয়া মোসলেম, মালেকা বেগম, আয়েশা বেগমসহ অনেকে। নিজেদের রান্না নিজেরা করেছি। পংকজ ভট্টার্চাজ্য, মতিয়া চৌধুরী রুটি বেলতেন ও রান্না করতেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো আমরা সংগঠিত হয়ে বর্ডার ক্রস করে যখন ওপারে পৌছি। তখন আমাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে চায়নি। ওই সময় ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমাদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়। ওই সময় আমাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বিএলএফ গ্রুপ।’
তিনি বলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সব বাধা পেরিয়ে দেশে ফিরে এসে যুদ্ধ শুরু করি। আমি তখন আমাদের গ্রুপের ইস্টের ডেপুটি লিডার। যুদ্ধের সময় আমাদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং দেশের মধ্যে পাকিস্তানিদের দোসর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিএলএফ গ্রুপকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। অর্থাৎ বিএলএফ গ্রুপকে আমরা বিশ্বাস করতে পারতাম না। কারণ তারা আমাদের অনেককে অপারেশনে যাওয়ার কথা বলে সঙ্গে নিয়ে হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম পটিয়া কলঘাট এলাকায় বিএলফ গ্রুপ আমাদেরকে মেরে ফেলার জন্য অ্যাম্বুশ নেয়। বিষয়টি আমরা আঁচ করতে পেরে স্থান ত্যাগ করি।’ স্বাধীনতার পরও বিএলএফ গ্রুপ আমাদের অনেক লোককে হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/রমু