তাদের নতুন ঘর, তবুও ঠাঁই নেই ‘সমাজে’
৩১ মার্চ ২০২৩ ২২:১৫
গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে ফিরে: ‘এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে দেড় বছর আগে ঘর পেয়েছি। এখন আগের চেয়ে ভালো আছি। তবে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারছি না। স্কুল অনেক দূরে। কাছের মসজিদে মক্তব হলেও সেখানে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারি না। কারণ সমাজে উঠতে হলে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। সমাজে না ওঠায় পাশের মসজিদে-মক্তবে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারছি না। কিছুদিন আগে এখানকার (আশ্রয়ণ) একজন মারা গেলে তাকে কবর দিতে হয়েছে আগের এলাকায়।’— কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের গোয়ানইঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নলঝুড়ি পশ্চিমপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের একজন বাসিন্দা।
একই ধরনের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন আরও অনেকেই। তথাকথিত সমাজব্যবস্থায় ‘কলোনির’ খ্যাতি পাওয়া ওই বাসিন্দারা এখন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পেই স্কুল ও মসজিদ চান। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা চান কবরস্থানের ব্যবস্থাও।
সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পাহাড়ঘেঁষা জাফলংয়ের পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নলঝুড়ি পশ্চিমপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য নজরে এসেছে। সারাবাংলা’র হাতে এ সংক্রান্ত কথোপকথনের ভিডিও-ও রয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা শিমুল (ছদ্মনাম) নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কোনো রকমে টেনেটুনে সংসার চালাই। ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারি না। সমাজের সদস্য না হওয়ায় মসজিদের মক্তবে ছেলেমেয়েদের দিতে পারছি না। কারণ সমাজে উঠতে হলে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। ৫ হাজার টাকা না দিলে মসজিদের মক্তবে পড়তে দেবে না। সমাজের লোকেরা বলেন, ওরা কলোনির মানুষ। ওদের মসজিদ সরকারে দেবে।’
স্থানীয়দের এমন আচরণের প্রতিবাদে তারা কি বলেন জানতে চাইলে ওই গৃহিনী বলেন, ‘তখন তারা বলে তোমরা সমাজে ওঠো, সমাজে উঠলে ৫ হাজার টাকা লাগবে। এখন স্যার ৫ হাজার টাকা আমরা কোথায় পাবো?’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক গৃহিনী আতিকা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সমাজে উঠতে গেলে ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা লাগে। কিছুদিন আগে কলোনির একজন মুরব্বি মারা গেছেন, সমাজের লোকেরা ওনাকে এখানে কবর দিতে দেয়নি, গ্রামে নিয়ে কবর দিতে হয়েছে।’ এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরও একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেও একইরকম তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে নলঝুড়ি পশ্চিমপাড়া সমাজের মসজিদে হেঁটে যেতে সময় লাগে ৫ থেকে ১০ মিনিট। ওই সমাজের ২৩০ টি পরিবারের ছেলে মেয়েরা মসজিদের মক্তবে পড়াশোনা করে। মক্তবে পড়ানোর জন্য দুজন হুজুর রয়েছেন। এছাড়া সমাজের অধীনে কবরস্থানও রয়েছে। সমাজের প্রতিনিধিরাও জানিয়েছেন, সমাজের সদস্য হলে একটি নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দিতে হয়। সেই টাকা একত্রিত করে কখনও করবস্থানের জায়গা কেনা হয় কিংবা অন্য কোনো সামাজিক কাজে ব্যয় করা হয়। এছাড়া পরিবার প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের চাঁদাও রয়েছে, যা সমাজের সদস্যভুক্ত প্রতিটি পরিবারকে দিতে হয়।
ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশেই একটি মনিহারি দোকান রয়েছে। সরেজমিনে ওই মনিহারি দোকানের মালিকসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপেও উঠে এসেছে, ওই সমাজের সদস্যভুক্ত পরিবার ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিবারগুলোর মধ্যে একটি বিস্তর ফারাক রয়েছে। আধুনিক সভ্যতায়ও যেন ‘সমাজ ব্যবস্থার’ নামে তাদের মধ্যে ‘আলাদা একটি দেয়াল’ রয়েছে!
জানতে চাইলে নলঝুড়ি পশ্চিমপাড়া সমাজের প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে সারাবাংলা বলেন, ‘মসজিদে সবাই নামাজ পড়তে পারে। মক্তবেও সবাই আসে। আমাদের সমাজে ২৩০টি পরিবার। আশ্রয়ণ প্রকল্পে আরও ৭০টি পরিবার আছে। মক্তবে হুজুর আছে দুইজন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ছেলেমেয়েদের পড়াতে হলে আরও হুজুর লাগবে। তখন তাদের বলেছিলাম তোমরা হুজুরের ব্যবস্থা করো। তখন তারা তা করেনি। আমি নিজে হুজুর রেখে আপনার ছেলেমেয়েকে পড়াব তা তো হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে যারা আছে তারা ঘর প্রতি মাসে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়েই হুজুরদের বেতন দেওয়া হয়। সমাজে নতুন কেউ এলে তাদের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার করে যে টাকা নিই, সেটি একত্রিত করে কবরস্থানের জায়গা কিনি। সমাজে উঠতে হলে যে ৫ হাজার টাকাই দিতে হবে এমন নয়। কেউ ২ হাজার দেয়, কেউ ৩ হাজার দেয়।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের একজনের কবর প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে দিতে হয়েছে এমন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে কবর দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে কেউ আসেনি। তারা বলেছে- যিনি মারা গেছেন তাকে পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হবে। এখানে অন্য কারো কবর দেওয়া যায় না বিষয়টিও সত্য নয়। বরং বন্যার সময় যখন জায়গা হচ্ছিল না তখন অন্য এলাকার ৪ জনের কবর আমাদের সমাজের কবরস্থানে দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি তিনমাস হয়েছে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়েছি। ৭১ সদস্যবিশিষ্ট ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের সদস্যরা ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য ইসলামিক মক্তব চেয়েছে। তাদের বলেছি, নিজেদের মধ্যে সমাজ ব্যবস্থা চালু করতে। ওই আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে স্কুল এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুলে যেতেও সমস্যা। তাই তাদের চাহিদা প্রাক-প্রাথমিক স্কুল ও ইসলামিক শিক্ষার জন্য মক্তব। আমার মতে সেখানে কোনো এনজিও সংস্থা বা সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল করে দেওয়া হয় সেটি খুবই কাজে আসবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি যখন গিয়েছিলাম তখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। সমাজ থেকে যে টাকাটি নেওয়া হয় তা দিয়ে হয়তো মসজিদ ও কবরস্থানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। সমাজের যারা আছে তারা মসজিদ ও মক্তবের জন্য বেতন-ভাতাও দেয়। কিন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পে সবার যে সামাজিক অবস্থা, পাশের সমাজে যদি তাদের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়, তবে সবাই মাসিক চাঁদা দিতে পারবে না। হয়ত ৭০ পরিবারের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ পরিবার আগ্রহ দেখাবে। একমাত্র সমাধান তাদের নিজেদের মধ্যেই একটি সমাজ ব্যবস্থা চালু করা। এবং সেখানে প্রাক-প্রাথমিক স্কুল ও মক্তব তৈরির উদ্যোগ নেওয়া। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে যেটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব তা করা হবে।’
জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিলেটে অঞ্চলভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে প্রত্যেকটি মৌজার জন্য আলাদা সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীন যারা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছে তাদের পার্শ্ববর্তী সমাজ ব্যবস্থায় মিশতে একটু সময় লাগবে। কারণ তারা একেকজন একেক জায়গা থেকে এসেছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সমাজে ঢুকতে টাকা লাগবে এটি আজকেই শুনলাম। বিষয়টি আমরা দেখব।’
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রাক প্রাথমিক স্কুল ও মসজিদ-মক্তব করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো একটি প্রকল্প নিয়ে সেখানে স্কুল ও মসজিদ করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে