যেভাবে নিয়ন্ত্রণে এলো ইকবাল রোডের জ্যাম
২ এপ্রিল ২০২৩ ১১:১৫
ঢাকা: মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড ও তার আশপাশের এলাকায় অন্তত এক ডজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরে তীব্র জ্যামে নাকাল এলাকাবাসী। শুধু ইকবাল রোড ও এর আশপাশের এলাকাতেই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু ও ছুটির সময় জ্যামের ধাক্কা যেয়ে পৌঁছায় নিউমার্কেট পর্যন্ত। এলাকায় ঢুকতে ও বের হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে নাকাল এলাকাবাসীর দাবি ছিলো, এলাকাটিকে জ্যামমুক্ত করতে কোন না কোন উদ্যোগ নেওয়া। আর সেই দাবির প্রেক্ষিতেই কাজ শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের ট্রাফিক বিভাগ।
গত ৬ মাসের চেষ্টায় বর্তমানে এই এলাকা অনেকটাই চলাচল উপযোগী করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এর এই সফলতার অন্যতম কারিগর পুলিস ইনস্পেক্টর আতিক মাহমুদ। ২০২০ সালে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের টিআই অ্যাডমিন হিসেবে গণভবন পুলিস বক্সে জয়েন করেন তিনি। ইকবাল রোড, রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গণভবন, স্যার সৈয়দ রোডসহ বেশ বড় একটি এলাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান তিনি।
যোগদানের পরই জানতে পারেন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের ডিসির কাছে একাধিকবার এই এলাকার ট্রাফিকজ্যাম নিরসনের আবেদন করা হয়েছে। তার নিজের সন্তানসহ আত্মীয় ও বন্ধুদের অনেকের সন্তান এই এলাকার স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে। ফলে ডিউটি করার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেই এখানকার তীব্র জ্যামের ফলে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয় তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেন ইনস্পেক্টর আতিক। ৬ মাসের বেশি সময় ধরে এলাকার পরিস্থিতি জরিপ করার পাশাপাশি এলাকাবাসী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জ্যামের কারণ নির্ধারণের চেষ্টা করেন তারা।
সারাবাংলাকে আতিক বলেন, ‘ইকবাল রোড ও আশপাশের কয়েকটি এলাকায় ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। স্কুল শুরু ও ছুটির সময়ে এখানে একসঙ্গে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ড্রাইভার, রিকশা সব মিলিয়ে লাখের ওপর মানুষের সমাগম হয়। ফলে আটকে যায় সব রাস্তা। ট্রাফিক পুলিশকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় এই তীব্র জট সামলাতে। তারই প্রেক্ষিতে সমাধান খুঁজতে ছয় মাস ধরে কাজ করে বেশ কয়েক ধাপে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছি। একে লেন চালু করা, বিকল্প পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা, এলাকাবাসী ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে সম্পৃক্ত করা, কয়েকটি রাস্তায় নির্দিষ্ট সময় রিকশা বন্ধ রাখাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এখন অনেকটাই সুফল পাচ্ছি আমরা।’
ইকবাল রোড ঘিরে জ্যামের কয়েকটি কারণ খুঁজে পান ইনস্পেক্টর আতিক ও তার দল। দেখা যায়, এখানে অল্প দূরত্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি, বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারসহ অন্য প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার্থীদের বড় অংশ আশপাশের ও অন্যান্য এলাকা থেকে আসা-যাওয়া করে। ছাত্র-ছাত্রীদের আনা-নেওয়ার জন্য কয়েক হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে এই রাস্তায়। এদের মধ্যে অনেকেই আবার রাস্তার দুই পাশে গাড়ি পার্ক করে রাখে। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি আসে প্রচুর রিকশা। বিশেষ করে অল্প দূরত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা রিকশা করেই স্কুলে যাওয়া-আসা করে। ফলাফল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তীব্র জ্যাম।
এলাকা জ্যাম মুক্ত করতে তাই সবগুলো স্কুলে একসঙ্গে এতগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি আসা ও পার্ক করা বন্ধ করা দরকার ছিল সবার আগে। স্কুলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বসেন তারা। এর মধ্যে সবার আগে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে রেসডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ। ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিশাল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত গাড়ি করে আসে। ইনস্পেক্টর আতিক প্রিন্সিপাল বিগ্রেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদকে অনুরোধ করেন স্কুলে কয়েকটি বাস দেওয়ার জন্য ও স্কুলের ভেতরে অন্তত কয়েকশ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে। স্কুলের ভেতরে বিবেচনা সাপেক্ষে স্কুলের পাসের মাধ্যমে কয়েকশ গাড়ি পার্কিংয়ে রাজী হন প্রিন্সিপাল ফরহাদ। বর্তমানে তারা ১২টি স্কুল বাস চালু করেছে ও স্কুলের ভেতরে তিনশ গাড়ি পার্কিং করছে।
এছাড়া পাশে আড়ংয়ের গলির ওদিকে রাস্তার দু’পাশে আরও অন্তত ৫০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন ইনস্পেক্টর আতিক। এভাবে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ ঘিরে যে তীব্র জ্যাম তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগে রেসিডেন্সিয়ালের জ্যাম নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে যেত। ট্রাফিক অ্যালার্ট চলত, রেসিডেন্সিয়াল ছুটি হয়েছে। এখন স্কুল বাস চালু করায় ও মিরপুর রোড থেকে পার্কিং সরানোয় সেই জ্যাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’
এলাকার আরেকটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। যেখানের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। এখানেও একটি অংশ শিক্ষার্থী আসে ব্যক্তিগত গাড়ি চেপে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের পক্ষে পার্কিংয়ের জায়গা দেওয়া সম্ভব না। তারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ৫ জন কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে সাহায্য করছেন।
মিরপুর রোডের পাশে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ থেকে শুরু করে, ইকবাল রোড ও এর আশপাশে রয়েছে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, ওয়াইডাব্লিউসিএ, সেন্ট জ্যাকব, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল টাইটি টটসসহ ইকবাল রোড কাছাকাছি এলাকার একাধিক স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দু’য়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি স্কুলগুলো থেকে কার পার্কিং বা স্কুল-বাস চালুর ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। তবে স্কুলের সময় এগিয়ে-পিছিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই এগিয়ে আসেন।
এক বছর আগে ইকবাল রোড ওয়ান-ওয়ে করার পর অনেকটাই সুফল পান তারা। এরপর দেখা যায় আল-আমিন মসজিদের গলিতে তীব্র জ্যাম। গত পহেলা জানুয়ারি থেকে স্কুল শুরু ও ছুটির সময় সকাল-বিকেল দুইবেলা এক ঘণ্টা করে দিনে দুই ঘণ্টা রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই রোডে। তবে শিশু শিক্ষার্থীদের সুবিধা বিবেচনা করে অন্য আরেকটি গলিতে রিকশা চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এতসব কার্যক্রমের আগে ২ সপ্তাহ ধরে মাইকিং করা হয়েছে বলে জানান ইন্সপেক্টর আতিক। তাছাড়া তিনি নিজে টিমের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পর্কে জানিয়েছেন। এরপর থেকে তারা অনুনোমোদিত পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা করা শুরু করেছেন।
ইকবাল রোড হাউজিং সোসাইটির সভাপতি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রাকিব বলেন, ‘আমাদের এলাকার আশেপাশে দশটা স্কুল। এজন্য আমাদের এলাকা যানজটে জিম্মি হয়ে গেছে। দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে এই এলাকা। যার মূল কারণ এলোপাতাড়ি পার্কিং, যত্রতত্র মোড় ইত্যাদি। যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগ দারুণ কাজ করছে এই এলাকায়। ইনস্পেক্টর আতিক নিজে সকাল ছয়টা-সাড়ে ছয়টা থেকে এসে কাজ শুরু করেন যার ফলে যানজট অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। তবে ট্রাফিক বিভাগ দিনরাত কাজ করেও লাভ হবে না, যদি না সবাই মিলে সচেতন হয় ও কাজ করে।’
একটি আবাসিক এলাকার মধ্যে এতগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি কিভাবে পেল জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম বলেন, ‘ইকবাল রোড ও আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি স্কুল। এসব স্কুলের মধ্যে অধিকাংশেরই সরকারের অনুমোদন নাই। সিটি করপোরেশন থেকে কোন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয় না। তবে কিছু কিছু স্কুল যেমন প্রিপারেটরি স্কুল, ওয়াইডাব্লিউসিএসহ বেশ কয়েকটি স্কুল যারা নিজেদের নামে বরাদ্দ করে নিয়েছেন, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীর সন্তানরা পড়াশোনা করে দেখে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও এটি নিয়ে কিছু বলা হয় না বা করা হয় না। বাড়িওয়ালারাও স্কুল, কোচিং সেন্টার, হোটেল, রেস্টুরেন্টকে ভাড়া দেন। তাদের আমরা শুধু নোটিসই করতে পারি, কিন্তু আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়ায় জরিমানা করতে করার বা অন্য কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নাই।’
বর্তমানে ইনস্পেক্টর আতিক এই এলাকায় আসার পর থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহনশীল হয়েছে। আমরা একাধিকবার স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসেছি। তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা করে স্কুলের সময় এগিয়ে-পিছিয়ে নিয়ে আসে। এভাবে সব মহলের নানা পদক্ষেপে এই এলাকার জ্যাম অনেক কমে এসেছে বলেও জানান এই কাউন্সিলর।
সারাবাংলা/আরএফ/এমও