বায়রা লাইফের টাকায় চেয়ারম্যানের স্ত্রীর নামে ফ্লোর কেনার অভিযোগ
৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১০ | আপডেট: ৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১২
ঢাকা: বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্সের টাকায় ফ্লোর স্পেস কিনে প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রির অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, বায়রা লাইফের টাকায় রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জমি ও ফ্ল্যাট কিনে এসবের বেশির ভাগই কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রি করা হয়নি বলেও জানা গেছে। বাংলাদেশ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
এছাড়া, কম দামে জমি ও ফ্ল্যাট কিনে বেশি দাম দেখানো, বেশি দামে গাড়ি কিনে পরিচালনা পর্ষদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে কম দামে বিক্রি এবং কোম্পানির জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে অর্থ অত্নসাতেরও অভিযোগ উঠেছে পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। বিপরীতে গ্রাহকের টাকায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বিলাসী জীবনযাপন করলেও বছরের পর বছর হাজার হাজার গ্রাহক পলিসির মেয়াদ শেষে বিমার টাকা পাচ্ছেন না। মেয়াদ শেষে পলিসির অর্থ না পেয়ে গত ৭/৮ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন ১০ থেকে ১২ হাজার বিমাকারী। সম্মিলিতভাবে এসব গ্রাহকের পাওনার পারিমাণ ৫০ কোটি টাকা ছাড়িযে যাবে।
এসব গ্রাহক বিমার টাকা ফেরত পেতে প্রতিনিয়ত কোম্পানি অফিস, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ‘র কার্যালয়সহ বিভিন্ন মানুষের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। তারপরেও টাকা মিলছে না। এই অবস্থায় গত ২৩ মার্চ আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে বায়রা লাইফকে আগামী তিন মাসের মধ্যে কুমিল্লা, ফেনী ও সাভারের জমি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে গ্রাহদের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইডিআরএ‘র এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেছেন, ‘অতীতে বিমা খাতে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার বড় অংশই হয়েছে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাকে কেন্দ্র করে। দেখা গেছে, এক কোটি টাকা দামের সম্পদ ৩০ কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। ওই জমি ১০ বা ১৫ বছর পরে কেনা দামের অর্ধেকেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।’
জয়নুল বারী জানান, গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধ নিয়ে যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সেসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে তিনি বৈঠক করেছেন। কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে হলেও গ্রাহকের প্রাপ্য টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের নির্দেশনা মানা না হলে প্রয়োজনে কোম্পানির বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে।
বায়রা লাইফের টাকায় ফ্লোর কিনে সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি!
২০১১ সালে ২ ডিসেম্বর বায়রা লাইফের ১৪৬তম সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নয়াপল্টনের মাহতাব সেন্টারের দশ তলায় ১৭০০ স্কয়ার ফিট ফ্লোর স্পেস কেনার জন্য এনায়েত হোসেন চৌধুরীকে এক কোটি ১৮ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে ছয়টি কিস্তিতে বিক্রেতাকে এক কোটি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
পরে ১৬৬তম সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেই জায়গা নিবন্ধনের জন্য ১৭ লাখ ৮ হাজার ৭৮৭ টাকা তোলা হয়। কিন্তু পরে আবার ওই ফ্লোর স্পেস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং ওই ফ্লোর স্পেস বায়রা লাইফের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশারের স্ত্রী নাসরুন নেসার নামে রেজিস্ট্রি করা হয়। কিন্তু স্পেস বিক্রির সেই টাকা এনায়েত হোসেন চৌধুরী কোম্পানিতে ফেরত দিয়েছেন মর্মে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে গত ৬ মার্চ আইডিআরএ‘র এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় যত অনিয়ম
অন্যদিকে, ২০১২-২০১৩ সালে বায়রা লাইফ ফেনীতে ৯৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ফ্লোর স্পেস কিনেছে। যা এখনও কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রি করা হয়নি। ২০১২-২০১৩ সালে কেনা ফ্লোর স্পেস এখনও কোম্পানির নামে নিবন্ধিত না হওয়াতে কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণে পরিচালকরা আন্তরিক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে, ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই বায়রা লাইফ ঢাকার নয়াপল্টনের বিজয়নগরে মাহতাব সেন্টারের ১ হাজার ৭০৭ স্কয়ার ফিটের ফ্লোর স্পেস ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় কেনার চুক্তি করে। কিন্তু কোম্পানি কীভাবে রিয়েল এস্টেটের মালিককে সেই অর্থ পরিশোধ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত তদন্তকারী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই নারায়ণগঞ্জের বালু নদীর ইস্ট-ওয়েস্ট প্রোপার্টি থেকে ৪০ কাঠা জমি ৭ কোটি ৮০ কেটি টাকায় কেনেন। ওই জমিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পাশাপাশি কোম্পানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সুদ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ২০ কাঠা জমি ওয়াহিদুর রহমান নামে একজনের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। এবং তার কাছ থেকে ১৫ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণ করে। কিন্তু অডিটের সময় এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বায়রা লাইফ সাভারে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ পতিত জমি ৭২ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছে। যা বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না বলেও আইডিআরএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে, শেখ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ নামে একজনের কাছ থেকে খিলগাঁও রামপুরা রোডের বি-৬৬ প্লটটির ৮ কাঠা ৮ ছটাক জমি ১০ কোটি টাকায় বায়রা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশারের আমলে কেনা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি ওই জমি অগ্রণী ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেন। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে জমি কেনার ফলে কোম্পানির ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বেশি টাকায় গাড়ি কিনে কম দামে চেয়ারম্যানের মেয়ের কাছে বিক্রি
বায়রা লাইফের বর্তমান চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান চৌধুরীর জন্য কোম্পানি ৯৭ লাখ টাকা দিয়ে Lexus NX-2014 মডেলের একটি গাড়ি কেনে। কিছুদিন পর চেয়ারম্যানের মেয়ে লোমাতারা চৌধুরীর (পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য) কাছে ৫১ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকায় গাড়িটি বিক্রি করা হয়। যদিও তিনি প্রকৃত বিডার ছিলেন না। ফলে গাড়ি বিক্রিতে অনিয়ম হয়েছে মর্মে আইডিআরএ‘র তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও কোম্পানির বেশকিছু গাড়ি কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তারা ব্যবহার করছে। এসব গাড়ি তারা ফেরত দিচ্ছে না বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।
অডিটে বড় ধরনের অনিয়ম
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী কোম্পানির মোট অনিষ্পন্ন পেইড আপ পলিসির পরিমাণ ৮ কোটি ৩৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৫৭ টাকা, যা বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে দেখানো হয়নি। এর মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে কোম্পানির দায় কম দেখানো হয়েছে। সঠিক পরিমাণ দায় না দেখানোর ফলে বার্ষিক হিসাব প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ বলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া বায়রা লাইফের মোট ১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৫ টাকার বিভিন্ন ধরণের দায় রয়েছে। যা তারা আর্থিক হিসাব বিবরণীতে কম দেখিয়েছে।
বিমা আইন মানছে না বায়রা লাইফ
বিমা আইন, ২০১০ এর ২৭ ধারা অনুযায়ী কোম্পানিতে প্রতিবছর বার্ষিক হিসাব প্রতিবেদন প্রস্তুত করার বিধান থাকলেও বায়রা লাইফ ২০১৮ সালে সর্বশেষ হিসাব প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে আর কোনো হিসাব প্রতিবেদন করেনি। এছাড়াও বিমা আইন, ২০১০ এর ৩০ ধারা অনুযায়ী কোম্পানিতে প্রতিবছর দায় মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পাদন করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরির বিধান রয়েছে। কিন্তু বায়রা লাইফ ২০১৮ সালে সর্বশেষ দায় মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পাদন করেছিল। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত হিসাব প্রতিবেদন প্রস্তুত করেনি।
মো. হোসেন নামে বায়রা লাইফের চট্টগ্রামের একজন সাবেক এজেন্ট সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানির চেয়ারম্যান আবুল বাশার হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে চিট করেছে। কোম্পানিটাই একটা চিট কোম্পানি। এই কোম্পানির কারণে হাজার হাজার গ্রাহক পথে বসেছে।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কর্ণফুলী, বাঁশখালী, পটিয়া, পতেঙ্গা, হাটহাজারী এলাকার হাজার হাজার অতিদরিদ্র গ্রাহক বিমা করে মেয়াদ শেষে টাকা পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেই আমার মাধ্যমে বিমা করেছিল। বর্তমানে তাদের চাপে আমাকে অনেকটা পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। স্বয়ং ভুমিমন্ত্রী এ বিষয়ে একাধিকবার ফোন দিলেও গ্রাহকরা টাকা পাচ্ছেন না।’
এ ব্যাপারে বায়রা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নয়াপল্টনের মাহতার সেন্টারে কোম্পানির টাকায় আমার স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট কিনেছি, এটি মোটেও সত্য নয়। এমন কোনো ডকুমেন্ট কেউ দেখাতে পারবে না। কোম্পানির কাছ থেকে ওই টাকা আমি চেকে নিয়েছি, না ক্যাশে নিয়েছি তার কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না।’
কিন্তু বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে- আপনি কোম্পানি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করেছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল বাশার বলেন, ‘আইডিআরএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও তার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে না।’
বেশকিছু জমি ও ফ্ল্যাট আপনার আমলে কেনা হলেও গত এক যুগেও এসব রেজিস্ট্রি করা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব জমি ও ফ্ল্যাট কিস্তিতে কেনা হওয়ার কারণে রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি।’
এ ব্যাপারে বায়রা লাইফের এমডি প্রণব দাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা পরিশোধে আমাদের কুমিল্লা, ফেনী ও সাভারের জমি বিক্রির জন্য পত্রিকায় নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোম্পানির জমি ও ফ্ল্যাট গাড়ি কেনা বেচায় অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই।’
অন্যদিকে বায়রা লাইফের আরেক এমডি সুশান্ত প্রামানিক সারাবাংলাকে বলেন, “আমি চলতি বছরের ১ মার্চ কোম্পানির এমডি’র পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। কোম্পানিতে আমি যোগদানের সময় শর্ত দিয়েছিলাম, গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা পরিশোধে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু আট মাস দায়িত্ব পালনকালে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার গত ১ মার্চ আমি কোম্পানির এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেছি।”
উল্লিখিত অনিয়ম প্রসঙ্গে বায়রা লাইফ ইনসুরেন্সের বর্তমান চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যাযনি। তবে মফিজুর রহমান চৌধুরী কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম প্রসঙ্গে আইডিআরএ’কে বলেছেন, ‘বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগেই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এসব কারণে কোম্পানি বর্তমানে আর্থিক সংকটে পড়েছে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে।’
জমি কেনায় অনিয়ম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির আগের চেয়ারম্যান তার একক ক্ষমতাবলে এ ধরনের কাজ করেছেন।’
এ ব্যাপারে আইডিআরএ‘র পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বায়রা লাইফের অনেক গ্রাহক বিমা দাবি পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে আমরা অবহিত হয়ে কোম্পানির কুমিল্লা, ফেনী ও সাভারেব জমি আগামী তিন মাসের মধ্যে বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরতের নির্দেশ দিয়েছি।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম