।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘রাজীব যখন চিকিৎসাধীন ছিল তখন তারা হাসপাতালে এসে হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেছে। এরপর থেকে বাস মালিকের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগই হয় নাই। রাজীব মারা যাবার পরও বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি, খোঁজ নেয়নি’, বলেছিলেন বাস দুর্ঘটনায় নিহত রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম।
জাহিদুল জানান, রাজীবকে ঢাকা মেডিকেলে আনার পরদিন বিআরটিসি থেকে এসে বিশ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল। আর স্বজন পরিবহনের পক্ষ থেকে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর দুইবারে চল্লিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। একইভাবে রোজিনার চিকিৎসার সময় খরচ হিসেবে এবং মারা যাবার পর কিছু টাকা রোজিনার বাবার হাতে দেওয়া হয়েছে।
তবে রাজীব-রোজিনা ‘কিছু’ আর্থিক সহযোগিতা পেলেও এখনো কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে গ্রিনলাইন বাসের ধাক্কায় পা হারানো রাসেল, ৬ নম্বর বাসের চাপায় আহত নিলুফা বেগম এবং নিউমার্কেট এলাকায় বিকাশ বাসচাপায় আহত আয়েশা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, “যে বা যারা দুর্ঘটনায় নিহত বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা বাস মালিকদের তুলনায় অর্থ, ক্ষমতা এবং ‘সামাজিক স্ট্যাটাস’ এর দিক থেকে ‘নিম্নমান’ এর হন। তাদের পক্ষে পরিবহন মালিকদের থেকে অধিকার আদায় করা সম্ভব না। তাই এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।”
গত ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে দুই বাসের চাপায় প্রথমে হাত হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। পরে গত ১৭ এপ্রিল তিনি মারা যান। অপরদিকে, বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকাতে বিআরটিসি বাসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রোজিনা আক্তারের। গত ২৯ এপ্রিল ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অববস্থায় মারা যান রোজিনা।
রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন) ও স্বজন পরিবহনের পক্ষ থেকে রাজীব মারা যাবার পর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। অথচ উচ্চ আদালত রাজীবের চিকিৎসার পুরো খরচ দিতে নির্দেশ দিয়েছিল দুই বাস মালিককে। কিন্তু বাস মালিক পক্ষ ৬০ হাজার টাকা দিয়েই দায় সেরেছে।’
রোজিনার বাবা রসুল মিয়া বলেন, ‘ওনারা (বাস মালিক) হাসপাতালে একবার আইসা কিছু টাকা দিছে, আর গত শুক্রবার আইসা কিছু টাকা হাতে দিয়া গেছেগা। কিন্তু আমি তো এই টাকা চাই না, আমার মেয়েটাকে যারা এত কষ্ট দিয়া মাইরা ফেলাইলো, তাগো বিচার চাই।’
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে গ্রিনলাইন বাসের ধাক্কায় পা হারানো রাসেলের বাবা শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ১ মে গ্রিনলাইন পরিবহনের অফিসে রাসেলের অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম। চিকিৎসা হোক, ভালো হোক, কেবল এই আশ্বাসটুকু তাদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ নাই। টাকা-পয়সা তো দূরের কথা।’
কেবল টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয় কিনা এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, এটা কখনোই টাকা দিয়ে বিচার করা যাবে না। টাকার প্রশ্ন আসতে পারে চিকিৎসার বিষয়ে, সহযোগিতার ক্ষেত্রে।’
কিন্তু দুর্ঘটনাকে যেখানে টাকা দিয়ে ‘মিনিমাইজ’ করার চেষ্টা করা হয় সেখানে রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “টাকা দিয়ে সমঝোতা করা যায়, পরিবহন মালিকদের ভেতরে এ বিশ্বাস স্থায়ী হয়েছে- দুর্ঘটনা যাই হোক, প্রশাসন এবং ভিকটিমদের ‘অ্যানি হাউ ম্যানেজ’ করতে পারবো। তাই সড়ক দুর্ঘটনার মতো বিষয় পরিবহন মালিক সমিতি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী সংবেদনশীল আচরণের মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্র আর সরকারকেই।”
‘একশো ঘটনায় একটি বা দুটিতে ক্ষতিগ্রস্তরা চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সহযোগিতা হিসেবে কিছু টাকা পান আমরা দেখেছি এবং কোনওভাবেই একে হিসাবে ধরা যায় না’, বলে মন্তব্য করেন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাতে কিছু টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করার কোনও সুযোগ বাস কোম্পানির নেই। সব মিলিয়ে একজন মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন, তখন তার চিকিৎসা সহায়তা থেকে শুরু করে সামগ্রিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত।’
অপরদিকে, ‘সেফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্স’ এর সমন্বয়ক সদরুল হাসান মজুমদার সারাবাংলাকে জানান, ‘কিছু টাকা’ দিয়ে কখনই এই দায়িত্ব শেষ হবে না, এজন্য স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট পরিমান ‘কমপেনসেশন’ নির্ধারণ করতে হবে সরকার থেকে। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ তে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বাস্তবসম্মত ‘কমপেনসেশন ফিক্সড’ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা, অতি দ্রুত সময়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য প্রস্তাবিত আইনে ব্যবস্থা রাখতে সেফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook