Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ক্ষত শুকাতে, ক্ষতি পোষাতে ভরসা এখন প্রধানমন্ত্রী’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:৩৯

ঢাকা: বিকেল সোয়া ৩টা। ফজলুল হক মুসলিম হল, সরকারি কর্মচারি হাসপাতাল এবং বঙ্গবাজারের সামনের সড়কটা যেখানে এসে মিলিত হয়েছে, সেই জায়গাটা তখনও আর্তনাদে ভারী। পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়ার আগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নামিয়ে আনা মালপত্রের স্তূপের উপর বসে পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ধোঁয়াশে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। আর পরিবারের নারী সদস্যরা পাশে বসে বিলাপ করছেন।

সড়ক আইল্যান্ডে বসে বিলাপরত এক মহিলা বার বার বলছেন, ‘হে আল্লাহ, ঈদের আগে তুমি আমাদের এত বড় সর্বনাশ কেন করলা? আমরা এখন এ ক্ষতি মিটাব কী করে? আমাদের তো আর কিছু রোলো না। আমার ছেলেরা এখন কী করে খাবে? আমরা এখন কী করব?’

বিজ্ঞাপন

বয়স্কা মহিলার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আরেকজন নারী তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। যদিও তিনি নিজেও কাঁদছেন। বৃদ্ধ মহিলার পাশেই সাদা সবুজ পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা পরে বসেছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তিনি একেবারেই নির্বিকার। ছবি তুলতে গেলে হাতের ইশারায় ছবি না তোলার জন্য অনুরোধ করেন।

অদূরেই ফজলুল হক মুসলিম হলের দেয়াল ঘেঁষে রাখা কাপড়ের স্তূপের উপর বসে নির্বিকার তাকিয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী মো. ওয়াসীম। এনেক্স টাওয়ার মার্কেট ও বঙ্গ সুপার মার্কেটের ২৫টা দোকানে রেডিমেড গার্মেন্টস সরবরাহ করেন তিনি। ঈদ সামনে রেখে এবারও ৭০/৮০ লাখ টাকার তৈরি পোশাক সরবরাহ করেছিলেন তিনি। কথা ছিল-ঈদের বেচা-কেনা শেষে দোকানিরা তার সব টাকা শোধ করে দেবেন। কিন্তু মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি নিঃস্ব। তাই কাপড়ের স্তূপের উপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন।

সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে মো. ওয়াসীম বলেন, ‘আমি নিজেও গার্মেন্টস কারখানায় ৬০/৭০ লাখ টাকা দেনা। ব্যাংকেও লোন আছে। ঈদের পর এসব দায়-দেনা শোধ করার কথা ছিল। যাদের আমি মাল দিয়েছি, তারা সবাই শেষ। তাদের কাছে তো এখন টাকা চাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার কাছে যারা পাবে, তারা তো বিষয়টা বুঝবে না। তারা বলবে, আপনার দোকান তো পোড়ে নাই। এখন কী করব, কিছু ভেবে পাচ্ছি না।’

বিজ্ঞাপন

কারও কাছে কি কিছু চাওয়ার আছে?— এমন প্রশ্নের জবাবে মো. ওয়াসীম বলেন, ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি দয়া করে এই ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু একটা করেন, ক্ষতি পুষিয়ে দেন, তাহলে সবার মনের ক্ষতও দূর হবে। বিশ্বাস করেন, আমরা সবাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারছি না।’

সকালে যে মালপত্র বের করে এনেছিলেন, দুপুরে সেগুলো পিকআপ ভ্যানে লোড করে অন্যত্র নেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন মো. তোফায়েল আহমেদ সুমন। ঈদ সামনে ভস্মীভূত হওয়া বঙ্গ সুপার মার্কেটের ২টা দোকানে ৩০/৩৫ লাখ টাকার তৈরি পোশাক তুলেছিলেন তিনি। স্বপ্ন ছিল, ঈদের আগে সব মাল বিক্রি করে নিজের দায়-দেনা শোধ করবেন। তার সেই স্বপ্ন আগুনে পুড়ে শেষ।

সকাল থেকে বোধ হয় কয়েক দফা কেঁদেছেন সুমন। চোখের কোণে অশ্রু আর কাপড় পোড়া কালি— দুই-ই দৃশ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে কারও সঙ্গে কথা বলা যেকোনো ব্যক্তির জন্য দুস্কর। তারপরও কাছে গিয়ে হাল-হকিকত জিজ্ঞেস করতেই এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমরা শেষ ভাই। আমাদের সব শেষ। ২৪/২৫ বছর আগে নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় এসে, অনেক কষ্টে-শিষ্টে টাকা পয়সা রোজগার করে ২০০৭ সালে এখানে ব্যবসা শুরু করি। এই ব্যবসা দিয়ে শুধু আমার পরিবার না, অনেক মানুষের পরিবার চলে। আমার কাছ থেকে যারা মাল নিয়ে বিক্রি করে, কারও কাছ থেকেই অগ্রিম টাকা নিই না। বিক্রি করে তারা টাকা দেয়। এটাই এখানের নিয়ম। এবারও তাদের মাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’

যেগুলো আছে, এগুলো বিক্রি করা যাবে না?— এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন বলেন, ‘যা দেখছেন, এর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে ভিজেছে, ময়লা লেগেছে, ভাজ ভেঙেছে। এগুলো কেউ বিক্রি করতে পারবে না। রোদে দিয়ে শুকিয়ে, আইরন করে, নতুন প্যাকেট করার পর হয়তো কিছু মাল বিক্রি করা যাবে। আপাতত গোডাউনে নিয়ে যাচ্ছি। দেখি কী করা যায়।’

এরকম দুর্ঘটনার স্বীকার অতীতে হয়েছেন?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে যখন আগুন লাগে, তখন সামান্য কয়েকটা দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমি নিরাপদ ছিলাম। এবার তো সব শেষ। এবার আমরা সবাই নিঃস্ব। হাজার হাজার ব্যবসায়ী নিঃস্ব। এখন একমাত্র ভরসা প্রধানমন্ত্রী। ঈদের আগে তিনি আমাদের জন্য কিছু না করলে আমাদের আর্থিক ক্ষতি এবং মনের কষ্ট কোনোটাই দূর হবে না।’

একুশে হলের দেয়ালঘেঁষা বেঞ্চিতে বসে সমানে বিলাপ করছেন আরেক বৃদ্ধা। তার ছেলে অথবা স্বামীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কীভাবে পুড়েছে, কখন পুড়েছে- কান্নার মাধ্যমে সেই বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আশপাশে কেউ নেই তার। তারপরও মনের কষ্টে কেঁদে যাচ্ছেন আর অগ্নিকাণ্ডের নিদারুণ দৃশ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করছেন।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

অগিকাণ্ড ক্ষত ক্ষতি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবাজার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর